টেস্ট সাফল্যের মুকুটে নতুন পালক
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ১০টা ৫৭। মাহেন্দ্রক্ষণটা চলেই এলো। তাইজুল ইসলামের শর্ট বল ডিফেন্স করতে গিয়ে সিলি পয়েন্টে জাকির হাসানের হাতে ক্যাচ দিলেন ইশ শোধী। গতকাল শেষ বিকেলে একবার ও আজ সকালে একবার, মোট দুইবার রিভিউ নিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন শোধী। এবার আর বাঁচতে পারলেন না। জাকির বল তালুবন্দি করে নিউ জিল্যান্ডের শেষ উইকেট নিশ্চিত করলেন।
বোলিং প্রান্তে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছিলেন তাইজুল। আম্পায়ার আঙুল উচিয়ে আউট নিশ্চিতের সংকেত দিতেই তার খ্যাপাটে উদযাপন। ইনিংসে তার ষষ্ঠ উইকেট। ম্যাচে দশম। টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয়বার এমন কীর্তি তার। তাতে নিউ জিল্যান্ডকে টেস্টে ১৫০ রানে হারাল বাংলাদেশ। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় চক্রের লড়াই বাংলাদেশ শুরু করলো অভাবনীয় এক জয়ে, অকল্পনীয় পারফরম্যান্সে।
নিউজিল্যান্ডকে এর আগেও হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কিউই দূর্গ ভেদ করেছিল। এক বছর পর আবার সাদা পোশাকের ক্রিকেটে তাদের হারাল। এবার ঘরের মাঠে। প্রাপ্তিতে দুই জয়ই সমান সমান। তবে বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর এই ম্যাচের অনন্য অর্জন নিশ্চিতভাবেই সাফল্যের পালে বাড়তি হাওয়া দিচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ পেল ঊনিশতম জয়ের স্বাদ। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ তিন ম্যাচে দ্বিতীয় এবং পাঁচ ম্যাচ পর এই ফরম্যাটে মাঠে নেমে টানা দ্বিতীয় জয়।
আজ ম্যাচের শেষ দিন জয়ের থেকে ৩ উইকেট দূরে ছিল বাংলাদেশ। নিউ জিল্যান্ডের জন্য কাজটা ছিল কঠিন। ৩৩২ রানের জবাবে চতুর্থ দিন শেষে তাদের রান ছিল ৭ উইকেটে ১১৩। প্রথম সাফল্যের জন্য বাংলাদেশের অপেক্ষা করতে হয় ৪৮ মিনিট, দশ ওভার। ফিফটি পাওয়া ড্যারেল মিশেলকে থামান নাঈম হাসান। ওভারের চতুর্থ বলে উইকেট পেলেও প্রথম দুই বলে সুযোগ তৈরি করেছিলেন নাঈম।
প্রথম বল রিভার্স সুইপ করতে গেলে টাইমিং মেলাতে পারেনি। বল একটু জন্য শর্ট গালির ফিল্ডার জাকিরের হাতে পৌঁছায়নি। সোহান ও ডিপ গালি দিয়ে বল বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয় বল ইনসাইড এজ হয়ে ক্যাচ উঠে। শর্ট লেগে দাঁড়ানো শাহাদাত লাফিয়ে একটুর জন্য নাগাল পাননি। তৃতীয় বল ছিল ডট। চতুর্থ বলে বাংলাদেশ পেয়ে যায় কাঙ্খিত সাফল্য। মিশেল স্লগ সুইপ করলে বল তার ব্যাটের ওপরের অংশে লাগে। ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে থাকা ফিল্ডারকে একটু পেছনে রেখেছিলেন শান্ত। ওই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। দলের পরিকল্পনা কাজে লেগে যায়। সেখানে তাইজুল অল্প একটু সরে বল সহজেই জমিয়ে নেন।
পরের দুটি উইকেট নেন তাইজুল। কিউই অধিনায়ক টিম সাউদি মাঠে নেমে দ্রুত রান তোলায় ব্যস্ত হন। চার ছক্কায় সাজান তার ইনিংস। সাউদির টেস্টে ছক্কার সংখ্যা শুনলে অবাক হবেন। ৮৫টি। বর্তমানে খেলা চালিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১২৪ ছক্কা নিয়ে শীর্ষে বেন স্টোকস। একমাত্র বাংলাদেশ বাদে বাকি সবগুলো দলের বিপক্ষে তার ছক্কা রয়েছে। তাইজুলকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা উড়িয়ে ছক্কার বৃত্ত পূরণ করেন। এরপর মেহেদী হাসান মিরাজকেও আরেকটি ছক্কা উড়ান। আগ্রাসী এ ব্যাটসম্যান বেশিদূর যেতে পারেননি। ২৪ বলে ৩৪ রান করে তাইজুলের শর্ট বলে ক্যাচ দেন শর্ট মিড উইকেটে।
প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট পাওয়া বাঁহাতি স্পিনার কিউই অধিনায়কের উইকেট নিয়ে দ্বাদশ ফাইফারের স্বাদ পান। এরপর কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তার হাত ধরেই আসে জয়ের মুহূর্ত। ১১২ মিনিট ক্রিজে থেকে বাংলাদেশের জয়কে দীর্ঘায়িত করা শোধী শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ফিরলে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয় নতুন পালক।
মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে খেলা ৭ ক্রিকেটার আজও ছিলেন সিলেটে। একাদশের বাইরে থাকা আরো তিনজনও ছিলেন এই স্কোয়াডে। প্রত্যেকের জন্য এই আনন্দ নিশ্চিতভাবেই দ্বিগুণ। সবচেয়ে বেশি আনন্দ নিশ্চয়ই নতুন টেস্ট অধিনায়ক শান্তর। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই শান্ত অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। আগ্রাসী অধিনায়কত্ব, দারুণ ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তনে পারদর্শীতা, গোছানো পরিকল্পনায় বুঝিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেটের আভিজাত্যের ফরম্যাটে সেরা হওয়ার জন্যই এসেছেন তিনি। সাকিবের পর দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে তার যাত্রা শুরু হলো জয় দিয়ে। সিলেটের পর ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে তার নেতৃত্বে দল মাঠে নামবে।
এই জয়ে ১২ পয়েন্ট নিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় চক্রের যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশ। ঢাকায় আরো ১২ পয়েন্টের হাতছানি। সিরিজ জিততে পারলে হবে অতিমানবীয় কৃতি। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে যেদিন নিউ জিল্যান্ডকে প্রথমবার হারাল বাংলাদেশ, সেদিন ব-দ্বীপে কাক ডাকা ভোরে আনন্দের দিনটি এসেছিল চুপিসারে। দিনের আলো ফোটার আগে বাংলাদেশ থাবা বসিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড দূর্গে। আজ সবুজের আচ্ছাদনে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, হিম বাতাস গায়ে মাখিয়ে জয় উৎসবে মাতল শান্তর ব্রিগেডরা। জয়ের নায়ক স্পিনে বিষ ধরানো তাইজুল। গ্যালারিতে বড়জোর পনেরশ দর্শক ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হয়েছেন। আনন্দে তারা আত্মহারা। যে আনন্দ আগুনের স্ফূলিঙ্গ হয়ে ভেসে বেড়ায় ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রাণের মনের আয়নায়।