গণতন্ত্র: চট্টগ্রামের রাজনৈতিক রুহ আফজা
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংস্কারে স্টুডেন্টস' এলায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি-স্যাড প্রস্তাবিত ৭ দফার বিশ্লেষণ
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পটভূমিতে গত কয়েক মাসে উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছেছে। গণঅভ্যুত্থান’২৪ উত্তর সময়ে নানা কারণে জনমানসে অসন্তোষ ও প্রতিকূলতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এই অবস্থার মধ্যেই উঠে এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক দাবির একটি ধারাবাহিকতা, যা চট্টগ্রাম তথা দেশের গণতন্ত্র এবং স্বচ্ছতার অঙ্গীকারকে নতুন মাত্রা দিতে পারে। এই প্রস্তাবিত দাবিগুলোর প্রতি জাতির প্রত্যাশা এবং সাড়া কতটা প্রভাবশালী হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। একদিকে, এই দাবিগুলোর বাস্তবায়ন দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার সুযোগ প্রদান করতে পারে, অন্যদিকে, তাদের বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলোও স্পষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে, “গণতন্ত্র : চট্টগ্রামের রাজনৈতিক রুহ আফজা” শীর্ষক বিশ্লেষণে আমরা এসব দাবির গুরুত্ব, প্রভাব এবং বাস্তবায়নের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করব।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি চট্টগ্রামের জনগণের মাঝে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে Students’ Alliance for Democracy – SAD এর উত্থাপিত সাতটি দাবির বিশ্লেষণ আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং জনগণের ন্যায্য প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটায়। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্প্রতি যে প্রস্তাবিত সংস্কারমূলক দাবিগুলি সামনে এসেছে, তা আমাদের দেশের গণতন্ত্রের গভীর প্রয়োজনীয়তার একটি স্পষ্ট প্রতিফলন। এগুলোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার এবং স্বচ্ছতার জন্য যে প্রত্যাশা উঠে এসেছে, তা দেশের উন্নতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংস্কারে Students’ Alliance for Democracy – SAD এর উত্থাপিত সাত দফা দাবি :
১. সংবিধান সংস্কারের জন্যে সংবিধান সভা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে রাষ্ট্রের সব সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন ও গণপরিষদ গঠন করবেন। দরকারে নয়া সংবিধানের বেসিক প্রিন্সিপালের উপর গণভোট হবে। ইন্টেরিম গভমেন্ট স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করে এই পুরো ব্যাপারটার দেখভাল করবেন।
২. জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত, শহীদ, গুম ও ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরী, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিদান ও পুনর্বাসন প্রকল্প প্রণয়ন করা লাগবে।
৩. বাকশালি শাসনের যাবতীয় গুম, খুন, হয়রানি, জেল-জরিমানা, সম্পদ পাচার ও রাজনৈতিক মামলার সুষ্ঠু তদন্ত, ক্ষতিপূরণ ও সুরাহার বন্দোবস্ত করতে হবে।
৪. ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনের সকল প্রকাশ্য ও গোপনীয় আন্তর্জাতিক চুক্তি জনতার দরবারে পেশ করতে হবে।
৫. ভোট ডাকাত লীগ সরকারের ভ্যানগার্ড বাহিনী তথা পুলিশ, র্যাব, আমলা, ব্যাংকার সহ আরো যারা যারা জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এই লক্ষ্যে স্বাধীন কমিশন গঠন করা লাগবে।
৬. লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্রসংসদকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে।
৭. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যত দ্রুত সম্ভব তার কর্মপরিধি, পরিকল্পনা ও সময়সীমা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
এবার দাবিগুলোর বিশ্লেষণে আশা যাক।
প্রথমত, সংবিধান সভার নির্বাচন এবং নতুন সংবিধানের মৌলিক নীতির উপর গণভোটের প্রস্তাব একটি গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবিধান সভার মাধ্যমে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে তা দেশের আইন-ব্যবস্থাকে জনগণের প্রতিফলন হিসেবে গড়ে তুলবে। গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের মৌলিক নীতির ওপর জনগণের মতামত গ্রহণের প্রস্তাবটি স্বচ্ছতার নিশ্চয়তায় একটি বড় পদক্ষেপ। তবে, এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন কার্যকর করতে হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গঠিত স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কমিশনের কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে এর ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে আহত, শহীদ, গুম ও ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি এবং পুনর্বাসন প্রকল্প প্রণয়নের দাবিটি মানবিক এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকারের কর্তব্য ও দায়িত্বের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ দেশের মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই ধরনের পদক্ষেপ জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করবে এবং সামাজিক শান্তি স্থাপনে সহায়ক হবে।
বাকশালি শাসনের সময়কালে সংঘটিত গুম, খুন, হয়রানি, জেল-জরিমানা এবং সম্পদ পাচারের সুষ্ঠু তদন্তের দাবিটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য। এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা হলে দেশের ইতিহাসে অন্ধকার অধ্যায়গুলো পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হবে। এ জন্য একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন, যা সমস্ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত করবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করবে।
আওয়ামী শাসনের আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর জনসমক্ষে উপস্থাপনের প্রস্তাব সরকারের স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি একটি স্পষ্ট সংকেত দেয়। জনগণকে এই চুক্তিগুলোর বিষয়ে অবগত রাখলে তা সরকারের প্রতি আস্থার ভিত্তি তৈরি করবে এবং জনগণের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হবে।
ভোট ডাকাত লীগ সরকারের পুলিশের, র্যাবের, আমলার এবং ব্যাংকারদের বিচারের আওতায় আনার প্রস্তাব একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে। তবে, কমিশনের কার্যকারিতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে, যদি রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাব প্রযোজ্য হয়। এ জন্য কমিশনের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণের প্রস্তাব একটি প্রগতিশীল উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্রসংসদ কেন্দ্রিক রাজনীতি শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এর বাস্তবায়ন কেমন হবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও কার্যকরী পদক্ষেপের ওপর। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি সাধারণত ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও স্বাধীন চিন্তাভাবনা বাধাগ্রস্ত করে, তাই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা ও সময়সীমা জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবিটি সরকারের স্বচ্ছতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবগত রাখবে এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করবে। জনগণের কাছে সরকারের পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হলে তা সরকারের প্রতি বিশ্বাস ও সমর্থন গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
এই বিশ্লেষণের শেষে বলতে চাই, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক চিত্রটি একদিকে যেমন বিশাল পরিবর্তনের সম্ভাবনা বহন করে, অন্যদিকে তেমনি তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং। সার্বিকভাবে, এই প্রস্তাবগুলো দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে, তাদের বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এবং পদক্ষেপের বাস্তবতা নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। বাস্তবিকভাবে কার্যকর এবং স্বচ্ছ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সম্পাদনের সময় সতর্কতা এবং নিখুঁত পরিকল্পনা প্রয়োজন। এই দাবিগুলোর মাধ্যমে একদিকে যেমন উন্নত গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বাস্তবতার মাটিতে পা রেখে কার্যকরী পদক্ষেপের আশায় চট্টগ্রামবাসী।
সবশেষে, বলতে চাই—যতই বড় পরিকল্পনা হোক, বাস্তবতা কখনোই হালকা করে নেওয়া উচিত নয়। যেভাবে শহরের রাস্তাঘাটের সংস্কারের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থারও। তো, চলুন আমরা সবাই মিলে এই সংস্কারের জন্য একযোগে কাজ করি, এবং “গণতন্ত্র : চট্টগ্রামের রাজনৈতিক রুহ আফজা” শীর্ষক এই নতুন অধ্যায়ের শুরুতে আমাদের সমস্ত আশা ও প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখি। একটা কথা মনে রাখবেন, রাজনীতি কখনোই সার্কাস নয়—তবে ঠিকঠাক সংস্কার হলে রাজনীতি সত্যিই হতে পারে আমাদের সবার জন্য এক পাতে ইফতার করার সুযোগ।
(সমাপ্ত)
লেখক: সাজিদ সামী চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, দৈনিক ন্যায়ের আলো
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি