আয়নাঘর নিয়ে স্কাই নিউজের বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ

বিগত দেড় দশক স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ কতোটা ভয়াবহতার মধ্যে ছিল আয়নাঘর নিয়ে স্কাই নিউজের করা বিশেষ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তারই খণ্ডচিত্র। সাংবাদিক কর্ডেলিয়া লিঞ্চের করা ওই প্রতিবেদনে শুরুতেই দেখানো হয়, কীভাবে রাষ্ট্রীয় মদদে মানুষ হত্যা করে লাশগুলো ডুবিয়ে দেয়া হতো বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীতে। সেসব লাশ যেন ভেসে না ওঠে, সে জন্য সেগুলোর সাথে বেঁধে দেয়া হতো সিমেন্টের ব্যাগ। ফলে কখনোই সেসব লাশের সন্ধান পায়নি নিহতদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন।
স্কাই নিউজ জানায়, বাংলাদেশে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত বিশেষ কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭শ’ অভিযোগ জমা হয়েছে। কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিসের ধারণা, হাসিনার আমলে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে। এতো মানুষের খোঁজখবর বের করা কঠিন এক চ্যালেঞ্জ।
গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সরাসরি মানুষ গুম করার নির্দেশ দিতেন বলে অভিযোগ প্রসিকিউটরদের। গুম করা এইসব মানুষকে আটকে রাখা হতো আয়নাঘর নামে দেশব্যাপী বিস্তৃত শত শত বন্দিশালায়। অনেককেই বছরের পর বছরের পর আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। কাউকে কাউকে রাখা হতো চোখ বেঁধে। কারো-বা জায়গা হতো অপ্রশস্ত জানালাবিহীন অন্ধকার কুঠুরিতে। সম্প্রতি তারই একটি পরিদর্শনের বিরল সুযোগ পায় স্কাই নিউজ। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের অভিযোগে মামলা প্রস্তুত করছেন প্রসিকিউটররা।
পরিদর্শন করা আয়নাঘরেরই একটি কক্ষে ছিল বন্দিদের নির্যাতনের জন্য বিদ্যুৎচালিত ভয়াবহ স্পিনিং চেয়ার। বন্দিদের সেই চেয়ারে বসিয়ে অত্যধিক দ্রুত গতিতে ঘোরানো হতো। কাউকে ঝুলিয়ে রাখা হতো সিলিং থেকে, বা পরিয়ে রাখা হতো শেকল। কিছু কক্ষে নিষিদ্ধ মাদক, জাল মুদ্রা, এমনকি বিস্ফোরকের দেখা মেলে। প্রসিকিউটররা বলছেন, এগুলো ভুয়া তথ্য-প্রমাণ, এগুলোর অজুহাতেই আটকে রাখা হতো বন্দিদের। দেশজুড়ে এরকম অজস্র আয়নাঘরের খোঁজ মিলছে বলে জানান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৭০০ থেকে ৮০০ আয়নাঘর শনাক্ত করা হয়েছে। আমরা এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কিছু কমান্ডার ও কর্মকর্তাদের জবানবন্দি নিয়েছি। শেখ হাসিনার নির্দেশেই এসব কাজে অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা। হাসিনা যা করেছেন, তা সুস্পষ্টভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ। আমরা অবশ্যই আদালতে তা প্রমাণ করবো’।
প্রথম প্রকাশ্যে আসা এই আয়নাঘরে জোরালো শব্দে চালান হতো এক্সহস্ট ফ্যান। প্রকট শব্দ দিয়ে বন্দিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করার উদ্দেশ্যেই করা হতো তা।
সম্প্রতি আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছেন মানবাধিকার কর্মী মাইকেল চাকমা। চোখ বেঁধে একটি জঙ্গলে ফেলে যাওয়া হয় তাকে। ৫ বছর চার মাস পর প্রথমবারের মতো সূর্যের আলো দেখার সৌভাগ্য হয় তার। প্রতিনিয়ত বন্দিদশার ভয়াবহ ট্রমা বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বেঁচে ফিরবেন কল্পনাও করতে পারেননি মাইকেল। মারা গেছেন ভেবে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও সম্পন্ন করেছিল পরিবার। তার এই বেঁচে ফেরা যেন অলৌকিক।
এদিকে মাইকেল চাকমা ফিরে এলেও এখনও অনেকেই ফিরে আসেনি মৃত্যুপুরী আয়নাঘরগুলো থেকে। কী হয়েছে তাদের ভাগ্যে? নেত্র নিউজের এডিটর ইন চিফ তাসনিম খলিল বলেন, তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে এইসব বন্দিশালাকে হালাল করেছেন হাসিনা। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও তার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু হাসিনার সেই অজুহাত ছিল ভুয়া। বেশির ভাগ মানুষকেই সাজানো অভিযোগে বন্দি করা হয়।
বছরের পর বছর ধরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে শত শত পরিবার। মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ করে আসছে তারা। ধর্না দিচ্ছে দ্বারে দ্বারে। হাসিনা উৎখাত হওয়ার পর আয়নাঘর প্রকাশ্যে আসায় এখন নতুন করে আশায় বুক বাঁধছে তারা।
২০১৩ সালে গুম হন মানবাধিকারকর্মী সানজিদা ইসলামের ভাই, বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন। আদৌ বেঁচে আছেন তিনি? আজও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। না বেঁচে থাকলে অন্তত কোথায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে বা লাশ গুম করা হয়েছে, তা জানতে চায় পরিবার, যাতে সেখানে গিয়ে সাজেদুলের জন্য দোয়া করতে পারে তারা। জানাতে পারে শোক। এ প্রসঙ্গে সানজিদা বলেন, ‘সে যদি বেঁচে নাও থাকে, তাহলে কোথায় তার লাশ ফেলা হয়েছে, আমরা সেই জায়গাটার কথাও জানি না। এই কষ্টটা এতো ভারী যে, বয়ে নেয়া যায় না। যারা গুম হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের পরিবারের প্রতিটা সদস্যই বুকভাঙা এই কষ্ট নিয়ে বেড়াচ্ছে’।
আরো কতোকাল এই নরকযন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে? এর কী কোনো অবসান নেই? শুধু এটাই জিজ্ঞাসা গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর। অন্যদিকে হাসিনা বলছেন, তিনি কোনো অপরাধ করেননি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। এরই মাঝে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও, ভারতে আশ্রিত হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখী দাঁড় করানো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে নতুন দিনের বাংলাদেশের সামনে।