কমলগঞ্জে তিনদিনব্যাপী মণিপুরী “লাই-হরাউবা” উৎসব বুধবার

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে আগামী ২৩ হতে ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় মণিপুরীদের কৃষ্টি-ধর্ম-সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী আদি উৎসব “লাই হরাউবা”। উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নস্থ মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্সে ইউনেস্কো বাংলাদেশের অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, আইজিসিসি, পৌরৈ অপোক্পা মরুপ, ‘কনসোর্টিয়াম অফ ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব বাংলাদেশ’ (সিআইবি), ও সাধনা – এ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সাউথ এশিয়ান কালচার- এর সহযোগিতায় উৎসবের আয়োজন করেছে লাই হরাউবা স্টিয়ারিং কমিটি বাংলাদেশ।
রবিবার ২০ এপ্রিল বিকেলে কমলগঞ্জ প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান লাই হারাওবা স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক ইবুংহাল সিংহ, সদস্য সচিব ঔনাম লান্থোই ও সাংবাদিক রবি কিরন সিংহ। এতে ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পী অংশগ্রহণ করবেন। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরাচিলক নাফরিজা শ্যামা, নৃত্যশিল্পী, শিল্প পরিচালক, গবেষক এবং সাংস্কৃতিক কর্মী লুবনা মারিয়াম সহ ইউনেস্কোর প্রতিনিধি উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার প্রথম দিন দুপুর ২ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে লাই লৌখটপা (আচার অনুষ্ঠান), থৌগল জাগোই (প্রার্থনা নৃত্য), দলগত নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় দিন ভোর সাড়ে ৪টা হতে রাত ৯ টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে।
লাই ইয়াকাইবা (দেবতাদের জাগরণ), লাইপাও চেনবা (পুরোহিতের ভবিষ্যদ্বাণী), লাইবউ জাগোই (পুরোহিতের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দলগত নৃত্য), আচার অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সমাপনী দিনে ভোর সাড়ে চারটা হতে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে লাই ইয়াকাইবা (দেবতাদের জাগরণ), লাইপাও চেনবা (পুরোহিতের ভবিষ্যদ্বাণী), লাইগি থোরাম-পারেং (পুরোহিতের অনুষ্ঠান), লাইবু জাগোই (পুরোহিতের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দলগত নৃত্য), লাইগি থোরাম-পারেং (পুরোহিতের অনুষ্ঠান), মালেম শেম্বা ইয়ুমশারোল জাগোই (ঘর তৈরির নৃত্য), লাংখুল নুরাবি (নংপোক নিংথো ও পান্থোইবির মহাকাব্যিক থিয়েটার), উগ্রি হ্যাঙ্গেল (সাংস্কৃতিক ধর্মীয় গান ও নৃত্য)।
মনিপুরী লাই-হারাওবা একটি উৎসব যা মৈতৈ সংস্কৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। এটি মূলত, সনামহী ধর্মের ঐতিহ্যগত দেবতাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য উদযাপন করা হয়।
এই উৎসবে প্রদর্শিত নৃত্য সমূহকে মণিপুরী নৃত্যশৈলীর একটি সুপ্রাচীন নৃত্যধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মণিপুরী সমাজে প্রচলিত অন্যতম প্রাচীন লোকনৃত্যানুষ্ঠান ‘লাই হরাউবা জাগোই’ থেকেই এসেছে এই ‘লাই-হরাউবা উৎসব’।
এই নৃত্যে প্রকৃতি পূজার পরিচয় মেলে। লাই শব্দের অর্থ ইশ্বর, হরাউবা অর্থ আনন্দ এবং জাগোই অর্থ নৃত্য। অর্থাৎ নাচ গানের মাধ্যমে দেবতাদেরকে আনন্দ দান করা।
এর ইতিহাস এরকম সৃষ্টিকর্তা যখন জড় ও জীব পৃথিবী সৃষ্টি করলেন এবং পরবর্তীকালে স্রষ্টার মূর্তির অনুকরণে মনুষ্য সৃষ্টিতে সফলতা পেলেন তখন দেবদেবীগণ আনন্দে যে নৃত্য প্রকাশ করেছিলেন তারই নাম দেয়া হয়েছে লাই-হরাউবা নৃত্য। তাই লাই-হরাউবা নৃত্যে দেখা যায় পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে গৃহায়ন, শস্যবপন, জন্ম-মৃত্যু সবকিছুই নৃত্য ও সঙ্গীতের সুর লহরীতে ঝংকৃত হয়। এ নৃত্যের আঙ্গিক অংশগুলো যেমন লৈশেম জাগোই (সৃষ্টিনৃত্য), লৈতা জাগোই (গৃহায়ন নৃত্য) লৈসা জাগোই (কুমারী নৃত্য) প্রভৃতি মণিপুরী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে লোক সংস্কৃতি হিসেবে প্রদর্শিত হয়।
সৃষ্টিলগ্ন থেকে ছয় ধরনের প্রধান লাই-হরাউবা উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকলেও বর্তমানে লাই-হরাউবা নৃত্য দুই ভাবধারায় পরিবেশিত হয়। এই ভাবধারা দুটি হলো মৈরাঙ লাই-হরাউবা ও উমঙ লাই-হরাউবা। এই দুটি ধারাতেই পরিবশিত হয় নানা ধরনের কাহিনী নির্ভর নৃত্যগীত। এই নাচে তান্ডব ও লাস্য উভয় ধারাই ব্যবহৃত হয়। এই নৃত্য শৈব নৃত্যধারার হলেও, এতে পরবর্তী সময়ে রাসনৃত্যের ভঙ্গীপারেঙ-এর প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। এই নৃত্যধারার সাথে জড়িয়ে আছে, মণিপুরের সনাতন ধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব।
মণিপুরের লোক পুরাণ মতে- নয়জন লাইবুঙথ (দেবতা) এবং সাতজন লাইনুরা (দেবী) পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। আদিতে পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, আর সেই জলের উপর সাতজন লাইনুরা নৃত্য করছিলেন। এই দৃশ্য দেখে নয়জন লাইবুঙথ স্বর্গ থেকে লাইনুরাদের লক্ষ্য করে মাটি নিক্ষেপ করতে থাকেন। নৃত্যরতা সাতজন লাইনুরা সেই ছুঁড়ে দেওয়া মাটির উপর নেচে নেচে পৃথিবীর স্থলভাগ তৈরি করেন। এই ভাবনা থেকে লাই-হরাউবা নৃত্যের সূচনা হয়। এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন কিছু দেবদাস এবং দেবদাসী।
উল্লেখ্য, মণিপুরে দেবতাদের সেবায় যে পুরুষরা সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয় মাইবা (দেবদাস)। একইভাবে যে নারীরা দেবতাদের সেবায় সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয় মাইবী (দেবদাসী)।