বাংলাদেশ

উন্নয়নের মোড়কে মানুষ-সমাজ-প্রকৃতি ধ্বংসের এক রীতিমতো উৎসব চলছে চারদিকে

 

প্রতিবেদক -শেখ মঈনুল আজাদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

দূর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের কবল থেকে মানুষ ও সমাজ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত তেমন প্রকৃতিও আজ বিপর্যস্ত। এর মূলত শুরুটা হয় গত দশ বছরে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় পালিত হওয়া কিছু দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের হাত ধরে। তিন পার্বত্য জেলায় গত দশবছরে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। তবে সেটা ইতিবাচক পরিবর্তন নয় বরং নেতিবাচক প্রভাব এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পাহাড় কর্তনের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এরজন্য বাড়ছে পাহাড় ধস ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন হয়ে উঠছে দূর্বিষহ।

২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায় রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ছড়া এবং নদীগুলোতে কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। যার সত্যতাও লক্ষনীয় ছিলো যার কারণে সাজেকের গ্রামবাসীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে
পানীয় জলের অভাব সহ নানানমূখী সমস্যা।

পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে আসছেন এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলো। প্রকৃতিকে আঘাত না করে তারা জীবনধারণ করে আসছেন যুগের পর যুগ ধরে।

কিন্ত তারপরও একে একে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি যার কারণে আবহাওয়ায় আসছে বিস্তর পরিবর্তন। ২০২৩ সালের ৩০মার্চ ফেইসবুকে ভাইরাল হয় বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার কেউক্রাডং চূড়ার এক ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি গাছ ও পাহাড় কেটে করা হয়েছে রাস্তা ও উপরে তৈরি হয়েছে ইঁটের দালান! যার কারণে কেউক্রাডং হারিয়েছে তার পুরোনো রূপ। ঠিক যেমন ভাবে হারিয়েছে সাজেক, কক্সবাজার, রাঙামাটি সহ পার্বত্য জেলার আদি সৌন্দর্য।

আনিকা আহমেদ

এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে পর্বতারোহী আনিকা আহমেদ বলেন ;
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ধারা ৬ এর (খ) স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কতৃর্ক সরকারী বা আধা-সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।

কিন্তু কতটা মানছি আমরা?
এই নির্বিচারে পাহাড় কাটা যেনো মহাউৎসবে রুপ নিয়েছে। ছোট খাট পাহাড় কেটে সাবার তোহ করেছিই আমরা এখন রাক্ষসেদের ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় গুলোও।
❝ পাহাড় ❞ শব্দটা শুনলেই আপনার আমার চোখে কি ভেসে আসে? গাড়ি চড়ে পাহাড়ে যাবো, গাড়ি থেকে নেমেই দেখবো কংক্রিটের তিন তারকা সু-উঁচু দালান? যাতে থাকবে টাইলস করা এসি রুম, মর্ডান ওয়াশরুম, ইনফিনিটি পুল, পাওয়া যাবে দেশি বিদেশি আইটেমের খাবারের রেস্তোরাঁ?

জ্বি তাই হবে। হবে না হচ্ছে আসলে আমাদের সন্তানদের পাহাড় শব্দ শোনার সাথে সাথে তাদের চোখে ভেসে আসবে এমনই কিছু। সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
মানুষ কোনো রকম কারণ ছাড়াই পাহার ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠেছে। আমাদের সন্তানেরা জানতেও পারবে না পাহাড়ের রঙ সবুজ। পাহাড়ের সতেজতা তাদের ছুতে পারবেনা। পাহাড়ের ঐতিহ্য জানবে না তারা। পাহাড়ের বিশালতা কিকরে আমাদের প্রকৃতি জলবায়ুতে অবদান রাখছে জানবে না তারা। অধিক মাত্রায় শব্দ দূষণ শোনা যাবে না পাখির মিষ্টি মধুর গান, ডাক রাতে শোনা যাবে না ঝিঝির শব্দ ও বায়ু দূষনে চোখে পরবে না আকাশের লক্ষ কোটি তারার মেলা।

একটা ঘরের যেমন খুঁটি বা পিলার থাকে। তেমনি জমিনেরও খুঁটি থাকে। পাহাড় হলো জমিনের খুঁটি বা পেরেক। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘনঘন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটা নিত্যনতুন কিছু নয়। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল ও গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন মজবুত রাখে। পাহাড় কাটার কারণে সেই বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলেই ঘন ঘন পাহাড় ধসের সৃষ্টি হয়। প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। মানা হচ্ছে না পরিবেশ সংরক্ষণ আইন
বাংলাদেশে মোট ভূমির এক পঞ্চমাংশ পাহাড়ি অঞ্চল। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৮% পাহাড়ি অঞ্চল অবস্থিত। বাকি ১০% অবস্থিত দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলে বেশ কিছু পাহাড় টিলা রয়েছে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলানিকেতন এই টিলা পাহাড় দেশি বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অথচ এই টিলা কেটেই পাহাড় ধ্বংসে মেতে উঠেছি আমরা। মানুষের আগ্রাসী থাবায় শত শত বছরের ঐতিহ্য আজ অস্তিত্ব হীনতার পথে।

তথ্যমতে, শুধুমাত্র চট্টগ্রামেই ২০০৩ সাল থেকে ২০২০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ১২৩টি পাহাড় কাটা হয়েছে। পাহাড় কেটে বন জঙ্গল উজাড় করার ফলে পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা দেখছি। অতি বৃষ্টি কিংবা খরা, সময়ে বৃষ্টি না হয়ে অসময়ে বৃষ্টিপাত বেড়েই চলেছে। মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতা কিংবা শীত ভয়ানক আকার ধারণ করছে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে পৌষ-মাঘ মাসে হাড় কাঁপানো শীতের পরিবর্তে গরম অনুভূত হওয়া, শীতকালীন সময় কমে গিয়ে গরমকাল বেড়ে যাওয়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় সময়ই ভূকম্পন অনুভূত হওয়া এসব কিছুই পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাবের ফলাফল। যাহ আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। দীর্ঘকাল ধরে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড়ের ফলে পাহাড়ের অবশিষ্ট মাটি আলগা হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে তীব্র বেগে নেমে আসা ঢল আলগা মাটি ধুয়ে নিয়ে নিচে নামার ফলে পাহাড় হয়ে পড়ে দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ। পাহাড় কাটার ফলে ভুমি ধ্বস ছাড়াও মাটির অণুজীব বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের দরুন প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

পাহাড় কেটে রিসোর্ট বানানো। পাহাড় কেটে গাড়ি চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা করতে গিয়ে পাহাড়ের গাছ-পালা অবাধে কেটে ধ্বংস করে অনেক বন্য পশু-পাখি হারিয়েছি আমরা প্রতিনিয়ত হারাতে হচ্ছে। গাছ-পালা কাটার ফলে প্রাণী জগতের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অতীতে গ্রামাঞ্চলে যেসব বন্য পশু-পাখি দেখা যেতো পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে তাদের অধিকাংশ এখন আর দেখা যায় না। আজ থেকে ৫ বছর আগেও যাহ এতোটা ছিলো না।

কোনো এক প্রতিবেদনে পরেছিলাম, এখন নতুন কৌশলে পাহাড় কাটা হয়। পাহাড়ের নিচে কিছুটা মাটি কাটা হয় বর্ষার শুরুতে, যাতে প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে। ফলে পুরো দোষটি প্রকৃতির উপর দিয়ে দেয়া যায়। আবার খরচও বেঁচে যায়।

পাহাড় কাটার ফলে ঝুঁকির মুখে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এই জন্য পাহাড়ের গায়ে অবৈধ বস্তি নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন করা, পাহাড়ে বাসকারী আশ্রয়হীন মানুষকে মৃত্যুঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া বন্ধ করতে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যাতে তারা কোনো দিনও ভুল করেও পাহাড় কাটার কথা মুখে আনতে না পারে।
মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক না হলে আমাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে সেই দায় শোধ করতে হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটা রোধে এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের সুরক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব অপকর্ম থেকে আমাদেরও বেরিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত যেসব আইন আছে সেসব আইনে যে শাস্তির বিধান বর্ণিত আছে তা সুপ্রয়োগ জোরদার করতে হবে। পাহাড় দখলদারীদের উচ্ছেদ করতে হলে যতটুকু জনবল বন বিভাগের থাকা উচিত সেসব বৃদ্ধিতেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের হাত থেকে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্ষায় কোনো না কোনো সময় ভারি বর্ষণ হবেই। তবে তার সঙ্গে পাহাড় কাটা, বনের গাছপালা কেটে ফেলার ঘটনা যোগ হলেই এর খেসারত চরমভাবে দিতে হবে আমাদের।
পাহাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে কিছুটা হলেও পাহাড় কাটা রোধ করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। পাহাড় ধ্বংসের কুফল সবাইকে বোঝাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ি বন ধ্বংসের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ে পুনরায় প্রকৃত পাহাড়ি বনায়নের (Indigenous Forestry) ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিরোধ হোক, প্রতিবাদ হোক, পাহাড় কেটে উন্নয়ন আমরা চাই না। উন্নয়নের মোড়কে প্রকৃতি ধব্বংসের এই উৎসব বন্ধ হোক অন্যথায় প্রকৃতির মহাপ্রলয় থেকে কেউ রেহায় পাবো না আমরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button