বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ আর নেই
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা গেছেন।
মঙ্গলবার রাত সোয়া এগারোটায় ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মামুন মুস্তাফি মঙ্গলবার রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে চালু হওয়া ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
গত ক’বছর ধরে তিনি পরোক্ষ রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও সম্প্রতি কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে একুশ শতকের করোনা ভাইরাস মহামারি এই – পুরো পাঁচ দশকেই কোনো না কোনো ভাবে আলোচনায় এসেছেন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশে অনেকেই যাকে সম্বোধন করেন গরীবের ডাক্তার হিসেবে।
তার স্কুল জীবনের সহপাঠী ও পরবর্তীকালে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ডা: মাহমুদুর রহমান বলছেন, চিন্তায় সৎ থেকে দেশের জন্য যেটা ভালো মনে হতো সেটাই সবসময় করে গেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
উনিশশো একচল্লিশ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে জন্মগ্রহণ করা জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন পরিবারে দশ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী থাকার সময়ে কলেজের দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় এসে পরে কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
মি. রহমান বলছেন, তখন থেকেই স্বাস্থ্যখাতের জন্য ভালো কিছু করার জন্য তিনি ছিলেন সবসময় একরোখা, কিন্তু নিজ আদর্শে অটল।
“ডাক্তারি পাশের পর আমরা দুজনই যুক্তরাজ্যে যাই। সেখানে থাকা অবস্থায় সার্জারিতে কাজ করে সার্জন হিসেবে সে সুনাম অর্জন করে। ৬৯ সালের ওই সময়ে আমরা সবাই দেশ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। সে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন গড়ে তোলে এবং তার নেতৃত্ব ছিলো বলিষ্ঠ।
“যুদ্ধকালীন সময়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। স্বাধীনতার পর বিলাতে না গিয়ে দেশেই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করলেন। গণস্বাস্থ্য -ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের স্বীকৃতি পায়।”
ইংল্যান্ডে থাকার সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রকাশ্যে পাকিস্তানী পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টার হামলার শিকার হয়েছিলো তাতে মি. চৌধুরীও ছিলেন একজন আরোহী।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আগরতলার মেলাঘরে তার গড়ে তোলা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের ধারাবাহিকতাতেই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগিতায় সাভারে গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সখ্যতা ছিলো দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচ এম এরশাদের সাথেও, যা নিয়ে তিনি আলোচিত-সমালোচিতও হয়েছিলেন।
এমনকি ঔষধ নীতি নিয়ে বিরোধের জের ধরে তাকে বহিষ্কারও করা হয়েছিলো বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন বা বিএমএ থেকে।
ডা: মাহমুদুর রহমান বলছেন, “তার ঔষধ নীতি বাংলাদেশের ঔষধ খাতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষ করে এর জন্যই আজকের বাংলাদেশে ঔষধ খাতের এতো উদ্যোক্তা।”
ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছেন, বিতর্ক বা সমালোচনা যাই হোক জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার একটি ভিন্ন মডেল দাঁড় করিয়েছেন যা তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
“স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তিনি চিন্তার জগতে পরিবর্তন এনেছেন। আগে চিকিৎসা, ঔষধ বা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে প্রশ্ন করার চিন্তা করতো না। সেটি তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। তিনি ব্যতিক্রমী ধারার সূচনা করেছেন। তার কাজের প্রতীক গনস্বাস্থ্য যেখানে মানসিক শ্রমের সাথে কায়িক শ্রমের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তিনি।”
ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতি করলেও পরবর্তী জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেননি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তবে সবসময়ই স্বাধীন রাজনৈতিক মতামতের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলেছিলেন তিনি।
সামরিক শাসকদের সময়েই স্বাস্থ্য নীতি, ঔষধ নীতি ও নারী শিক্ষা, এমনকি সে সময়ে সহজে দেশের মানুষের জন্য পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে সরকারকে রাজী করানো এবং প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে সরকারকে প্রভাবিত করতে তার ভূমিকা আলোচনায় এসেছে সবসময়।
তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ ও পারিবারিক বন্ধু ড: শাহদীন মালিক বলছে, জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন বিরল ধরণের নির্মোহ মানুষ।
“এক অর্থে অদ্ভূত মানুষ। ঢিলেঢালা শার্ট প্যান্ট। পুরোনা বাসায় আসবাবপত্র পুরনো। গাড়িটাও পুরনো। সব মিলিয়ে নির্মোহ একজন মানুষ। পাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। নিজের জন্য কিছু চাননি।
“কিন্তু শেষ বিচারে তিনি জীবনে মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সব পেয়েছেন। দেশ ও জাতির জন্য তার অবদান বলে শেষ করা যাবেনা”।
পঁচাত্তর সালে বাকশালের বিরোধিতা করেছেন আবার পরবর্তী কালে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ালে তিনি তার হয়ে কাজ করেছেন। পরে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিএনপি ও এর চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সাথেও।
পরবর্তীকালে ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হলে তাতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। এর মধ্যে আবার আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কের অবনতির জের ধরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি বেশ কিছু মামলাতেও তাকে আসামী হতে হয়েছে।
সবশেষে করোনাভাইরাস মহামারিতে তিনি ব্যাপক আলোচনায় আসেন তার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত টেস্ট কীট নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে বিরোধে জড়িয়ে।
তবে বিতর্ক সমালোচনা যাই হোক জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্যখাত নিয়ে চিন্তা ও কর্মের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে এনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।