কুরবান ও বিদায় হজের ভাষণ : রবুবিয়ত বা পালনবাদী দিকনির্দেশনা
কুরবান ও বিদায় হজের ভাষণ : রবুবিয়ত বা পালনবাদী দিকনির্দেশনা
……………………
লেখকঃ হাসান মারুফ রুমী
…………………………………….
মদিনায় হিজরতের পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথমে দুইটা দুম্বা নিজ হাতে কোরবানি দিয়েছেন। এবং বলেছিলেন, একটা আমার নিজের পক্ষ থেকে আরেকটা আমার উম্মতের পক্ষ থেকে।
সে সময় কুরবানির বিষয়টা ছিল অনেকটা হজ কেন্দ্রিক। যারা হজ বা ওমরাহ করতে যেতেন, তারা কুরবানির জন্য উট বা দুম্বার মতো পশু সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।
(২)
হজের প্রধান বিষয় সমর্পণ। নিজেকে পরমের কাছে সমর্পন। ধনী – নির্ধন – আরব – অনারব – প্রাচ্য – পাশ্চাত্য সারা দুনিয়া থেকে আগত নানা জাতি – ধর্ম – বর্ণের নারী -পুরুষ এক কাতারবদ্ধ হয় যেখানে।
বিদায় হজ্জের ভাষণে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন হে মানব মন্ডলী, কোন অনারবের উপর আরবের আরবের উপর অনারবের, শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের তদ্রূপ কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোন আধিপত্য কর্তৃত্ব থাকবে না।
আজকের দিনে জাতিবিদ্বেষ বর্ণবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছিলেন পয়গম্বর।
তিনি সেই ভাষনে আরো বলেছিলেন, ” তোমাদের কাছে যদি কারো আমানত গচ্ছিত থাকে তাহলে তা পৌঁছে দেবে এবং কারো কাছে কোন ঋণ থাকলে, সে ঋণ অবশ্যই পরিসোধ করবে।” সেটা আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে যদি বলি বাংলাদেশে যেন তার উল্টো স্রোতই চলছে। আমানত অনিশ্চিত হওয়া বা লোপাট করা রাষ্ট্রের বা সরকার ঘেষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি এমনকি সরকারি নির্বাহী-বিচার-আইন বিভাগের নানান ঘটনা দেখলে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
আরব অঞ্চলে গোত্র যুদ্ধ প্রায় লেগে থাকতো। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে যেতো।খুনের বদলে খুন ছিলো প্রতিষ্ঠিত সামাজিক রীতি। সেই রীতির ইতি টানলেন – ” জাহেলী যুগের যত রক্তের দাবি সব রহিত করা হলো।” এ ঘোষণার মাধ্যমে। শুধু এ ঘোষণায় থেমে থাকেননি – ” সর্বপ্রথম আমি রাবিয়া ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম।” এ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত হাজির করলেন। আসলে এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গোত্রে গোত্রে বিভক্ত, রক্তপাত ও যুদ্ধ মুখর একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক চুক্তির অধীনে এনে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের সূচনা করলেন। যেখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিরাপত্তা বিধান করবে। যার ফলাফল, সারা বিশ্ব পরবর্তীতে দেখেছে।
পয়গম্বর আরো বলেছিলেন, “পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী হবে না এবং পুত্রের অপরাধে কোন পিতাকে দায়ী করা হবে না।” গোত্র যুদ্ধ ও বংশ পরম্পরায় প্রতিশোধপরায়ণ আরব জনগোষঠির সামনে এমন ঘোষণা নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক।
মানবজাতির উপর পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উচ্চারণ ছিল – “ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা অতীতে অনেক জাতি এ বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে।” তিনি সতর্ক করলেন, তিনি নির্দেশ দিলেন। সদ্য বিজয় করা মক্কার বুকে এই ঘোষণা তার অনুসারীদের প্রতি যেমন সতর্কবাণী, তেমনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, জাতি ও বর্ণের জনগোষ্ঠীর জন্য আশার বাণী। যে রাষ্ট্রের পত্তন হলো সেখানে সবাই নির্বিঘ্নে নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে বসবাস করবেন।
বিদায় হজের ভাষণ শুরু করেছিলেন এ বলে যে, ” হে মানব মন্ডলী, স্মরণ রাখো আল্লাহ এক, তার কোনো শরিক নেই। মনে রেখো, একদিন তোমরা আল্লাহর নিকট হাজির হবে, সেদিন তোমাদের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে।” আর শেষ দিকে বলেছিলেন, ” তোমাদের কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তোমরা তখন কি বলবে? সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যুত্তরে বলেন, আমরা সাক্ষ্য দিব যে আপনার দিনের দাওয়াত দিয়েছেন তিনি, আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং ন্যাস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। মহানবী (সাঃ) এ কথা শুনে তর্জনি উত্তোলন করে লোকেদের দিকে ঝুকে তিনবার বললেন, হে রব আপনি স্বাক্ষী থাকুন,।” ইসলাম ধর্ম মতে আল্লাহর পর ইহকাল ও পরকালের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী পয়গম্বর। যাকে অগণিত উপাধি দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে প্রধান পাঁচটি সম্মানসূচক উপাধি হল –
১.শফিউল মুসনাবিন বা গুনাহগারদের জান্নাত প্রবেশের সুপারিশকারী।
২. রহমাতুল্লিল আলামিন বা সমগ্র জগতের রহমত।
৩. সাইয়িদুল মুরসালিন বা সকল নবী রাসূলের নেতা।
৪. খাতামুন্নাবিইয়িন বা নবীগণের সীলমোহর।
৫. ইমামুর রাব্বানীইয়িন বা রাব্বানীদের পথিকৃৎ।
যিনি সারা জীবন প্রচার করেছেন স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের কথা। যেখানে সকল কিছুই বিলীন হবে। যে পয়গম্বরের মাধ্যমে নাযিল হলো আসমানী গ্রন্থ আল- কোরআন, যেখানে তাকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হলো। যার জন্য বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান নির্ধারিত, সেই পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)তার কৃতকর্মের বা তার উপর অর্পিত দায়িত্বের কৈফিয়ত দিচ্ছেন তার উম্মতদের সাক্ষী রেখে, মেন্ডেট নিয়ে।যে মাইন্ডেট বা সম্মতি বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবসৃথা থেকে উঠে গিয়েছে। বর্তমান শাসকেরা জনগণের মত দেয়ার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দিয়েছে প্রচন্ড দানবীয় শয়তানি শক্তিতে।
৩
বহু ধর্মেই কুরবানী প্রথা প্রচলিত। সেমেটিক – ইব্রাহিমী ধর্মে তো বটেই। কুরবানী মানে ত্যাগ। প্রিয় জিনিস ত্যাগ করা।
আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)কে কুরবানি দেন। কিন্তু অলৌকিক নির্দেশে তার পরিবর্তে পশু কোরবানি হয়। অর্থাৎ পিতা তার পুত্রকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত খোদার সন্তুষ্টি লাভের জন্য। স্রষ্টা সন্তুষ্টি অর্জনের নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কে ত্যাগ করার নামই কোরবান আল্লাহর কাছে গরু- মহিষ – উট – দুম্বা – ছাগলের রকৃত বা মাংস কোনটাই পৌছায় না। পৌঁছাবে আত্মত্যাগের বাসনা বা মানসিকতা।
(৪)
কুরবান দর্শন বা বিদায় হজের ভাষণ খুব ভালো মতো খেয়াল করলে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া যায়। সেটা হল রুবুবিয়ত বা পালনবাদ। প্রতিপালকের অধীনে সকল মানুষ সমান। মুসলিম কি অমুসলিম, আরব কি অনারব, কালো কি সাদা, জাতি- ধর্ম – বর্ণ সকলেই সমান রবের কাছে। রবের অধীনে সকল মানুষ সমান,সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ও জবাবদিহির অধীন। স্রষ্টার সকল স্মৃষ্টির উপর সকল মানুষ তো বটেই প্রাণী- জীব – অনুজীব সহ সকল প্রাণের হক আছে।