চট্টগ্রাম মেডিকেলে গেটম্যান-ওয়ার্ড বয় নৈরাজ্য, টাকা হাতিয়ে নেন ভয় দেখিয়ে
নগরের চাঁদগাও এলাকা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন কছির উদ্দিনের মা। তিনি ২৭ নং সার্জারি ওয়ার্ডে ১৭ দিন ধরে ইনফেকশনজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি আছেন। সেখানে নানা ভোগান্তি ও অবহেলার শিকার হয়েছেন তারা।
কছির উদ্দিন বলেন, এই ওয়ার্ডে মোট ৫০টি শয্যা আছে। রোগী বেশি থাকায় ও বেড সংকটের কারণে প্রতিদিন অন্তত ৪০-৪৫ জন রোগীকে ওয়ার্ডের দুপাশে বারান্দায় চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। মূল ওয়ার্ডের দুপাশে বারান্দায় ইনফেকশনজনিত রোগীদের ভর্তি রাখা হয়। এসব রোগীর মেলে না যথাযথ চিকিৎসা। এসব রোগীর চিকিৎসাসেবায় অবহেলা এবং ভোগান্তি বেশি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, এ ওয়ার্ডে কর্মরত সিনিয়র চিকিৎসকেরা ওয়ার্ডের ফ্লোরে চিকিৎসা নেওয়া ইনফেকশনজনিত রোগীদের চিকিৎসাসেবায় বেশি অবহেলা করেন।
জানা যায়, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন, ক্যানসারের অপারেশন, ডায়াবেটিসসহ ইনফেকশনজনিত নানা জটিলতা নিয়ে এই ওয়ার্ডে ভর্তি হয় রোগীরা। মূল ওয়ার্ডের বেডে শয্যাশয়ী বেশিরভাগ রুটিন অপারেশনের রোগী। ওয়ার্ডের ভেতরে থাকা রোগীদের সঙ্গে ইনফেকশন রোগীদের যেন ক্রস ইনফেকশন না হয়, সেজন্য ইনফেকশনের রোগীদের বারান্দায় রাখা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, বারান্দায় অবহেলিত ইনফেকশনজনিত রোগীরা। সিনিয়র চিকিৎসকরা বারান্দায় ইনফেকশন রোগীদের তেমন সেবা দিতে আসেন না। এলেও ভালোভাবে সেবা দেন না। মূলত ইন্টার্ন চিকিৎসক, নার্স দিয়েই চলে ইনফেকশন আক্রান্ত রোগীদের সেবা। যথাযথ চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় ইনফেকশনের রোগীদের দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের মেঝেতে কাতরাতে হয়।
শুধু তাই নয়, রোগীদের বড় অংশের অভিযোগ— হাসপাতালের এই ওয়ার্ডের বারান্দা ঘিরেই আছে ওয়াশরুম। ওয়াশরুমের ভেতর পানির ব্যবস্থা, সাবান, হ্যান্ডওয়াশের ব্যবস্থা নেই। ময়লা, স্যাঁতসেঁতে বাথরুমের পাশেই প্রতিদিন জমে মেডিকেলসহ বিভিন্ন বর্জ্য। তার পাশেই বারান্দার মেঝেতে চলছে ইনফেকশনজনিত রোগীর চিকিৎসা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ইনফেকশনে আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এভাবেই বাড়ছে।
সীতাকুণ্ডের নাজমা হকের স্বামী তিনদিন ধরে এই ওয়ার্ডের বারান্দায় ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, বারান্দায় সিনিয়র চিকিৎসক ঠিকভাবে দেখতে চান না। অনেক সময় আসেনও না। ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা চিকিৎসা দেন। এছাড়া নার্সদের ডাক দিলে তারাও আসেন না। উল্টো চিল্লাচিল্লি করেন। যেসব রোগী দুদিনে সুস্থ হওয়ার কথা সেসব রোগীদের সুস্থ হতে অন্তত ৫-৬ দিন লেগে যায় এখানে
কর্ণফুলী এলাকার কালামিয়া বাজার এলাকা থেকে আসা আরেক রোগীর স্বজন শাখাওয়াত বলেন, এখানে ওয়ার্ডে রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করতে যত অর্থ খরচ হয় তার চেয়ে গেটম্যান, লিফটম্যান, ওয়ার্ডবয়— এদেরকে টাকা দিতে আরো বেশি অর্থ খরচ হয়।
তিনি বলেন, তিনদিন ধরে আমার জেঠাতো ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে এখানে এসেছি। ভোগান্তির শেষ নেই। লিফটে একটা রোগীকে তুলতে ১৫০ টাকা দিতে হয়। এরপর গেটম্যান, ওয়ার্ডবয়কে টাকা না দিলে রোগীকে ধরে না।
তিনি আরও বলেন, এখানে ওয়ার্ডের বারান্দার রোগীরা ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পায় না। অবহেলিত রোগীদের চিকিৎসা চলে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্স দিয়ে। আর ওয়াশরুমের পাশে থাকা রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। মাঝেমধ্যে আমরাই এসব বর্জ্য পরিষ্কার করে রোগীকে কিছুটা সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করি।
যোগাযোগ করা হলে ২৭ নং সার্জারি ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসক সাইফুল বলেন, এখানে বর্তমানে ২০ জনের উপর ইন্টার্ন চিকিৎসক কাজ করছে। এটি পরিবর্তন হয়। এখানে কারা কোন বেডে চিকিৎসাসেবা দিবে, সেগুলো ঠিক করা আছে। আর আমরা সেভাবেই চিকিৎসা দিই। আমাদের এখানে সব রোগীই চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে।
বারান্দার অবহেলিত রোগী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের যতটা শয্যা তার চেয়ে বেশি রোগী। তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। যেসব ইনফেকশন রোগীর জটিলতা বেশি তাদের সুস্থ হয়ে উঠতে দেরি হয়। তবে সবাই চিকিৎসা পায়।
২৭ নং ওয়ার্ডের সিনিয়র চিকিৎসক প্রফেসর ডা. আহাদ বলেন, দিনে আনুমানিক ৪০-৪৫ জন রোগী আছে যাদের চিকিৎসা দিতে হয় ওয়ার্ডের বারান্দায়। তারা সবাই ইনফেকশন রোগী। রুটিন অপারেশনের রোগীদের ওয়ার্ডের ভেতরের শয্যায় রাখা হয়। ভেতরের শয্যার রোগীদের যেন ক্রস ইনফেকশন না হয় সেজন্য ইনফেকশনের রোগীদের বাইরে রাখা হয়।
বারান্দার পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তো জায়গা নেই চিকিৎসা দেওয়ার মতো, আমাদের রোগীর জন্য আছে ধরুন ৬টা শয্যা। কিন্তু আমাদের চিকিৎসা দিতে হয় ১২ জনের, এত শয্যা কোথায় পাব আমরা। আমাদেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের যদি আরো শয্যা থাকত তাহলে আমরা আরো সেবা দিতে পারতাম। ইনফেকশনজনিত রোগীদের মধ্যে গ্যাংরিন, সেলুলাইটিসসহ নানান রোগ দেখা দিতে পারে।
বারান্দায় রোগীদের চিকিৎসাসেবায় অবহেলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব চিকিৎসক কম-বেশি দেখেন। সবাই সব বেডে যাওয়ার সুযোগ হয় না। সবাইকে নির্দিষ্ট বেড সেট করে দেওয়া থাকে, সিনিয়র চিকিৎসকরা সেসব বেডে রোগীদের সেবা দিতে যান।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. মো. মোতাহের হোসেন বলেন, আমাদের এখানে ওয়ার্ডের বেডে যাদের চিকিৎসা করানো হয় তারা মূলত রুটিন অপারেশনের রোগী। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন, ক্যানসারের অপারেশনসহ বড় বড় অপারেশনের রোগীদের মূলত সেখানে রাখা হয়। আর বারান্দায় যেসব রোগীর রাখা হয় তারা মূলত ইনফেকশনের রোগী। তাদের চাইলেও আমরা বেডে দিতে পারবো না, কারণ ইনফেকশন ছড়িয়ে যেতে পারে। তাদের অধিকাংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।বারান্দায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ মাঝেমধ্যে হয়ত ময়লা-আবর্জনা জমে, যা ইনফেকশন রোগীদের জন্য ঝুঁকির। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, বারান্দায় প্রতিদিন সব রোগী দেখা হয়, সিনিয়র চিকিৎসক থেকে শুরু করে কর্মরত সবাই দেখেন। ডায়াবেটিসে রক্তনালী শুকিয়ে যায়, রক্ত চলাচল হয় না, এসব রোগীদের কন্ট্রোল থাকে না। সুস্থ হতে অনেক সময় লাগে। ইনফেকশনের রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যান না— এটি ভুল কথা