পাহাড় ভ্রমণ, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপন
সম্প্রতি দৈনিক ন্যায়ের আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক প্রকৌশলী জাহিদুল আলম আল-জাহিদ আন্ধার মানিক পাহাড়ী এলাকায় ভ্রমণ করেন । ভ্রমণের অীভজ্ঞতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন। আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে হুবুহু তা তুলে ধরা হলোঃ-
২০২৩ ঈদুল ফিতরের ২য় রাত ২.৩০ মিনিটে টোব্যাকো গেট থেকে ঢাকা হতে ১১টায় ছেড়ে আসা আলীকদমের উদ্দেশ্যে শ্যামলী পরিবহনে নারায়ণগঞ্জের সহযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হলাম। যাচ্ছি আন্ধার মানিক সামিট উদ্দেশ্যে আলীকদম।
সফর সঙ্গী নিয়ামুর রশীদ বিপ্লব, আওলাদ হোসেন, রফিকুল বাপ্পি, রাইসুর রাব্বি, মশিউর রহমান রিচার্ড, স্মরণী, সাদিক, উজ্জ্বল, অন্ঞ্জন দাস, পপি রানী সরকার, কৃষাণ বর্মন, রায়হান জামান, নাসরিন আক্তার রিয়া।
রাত ৩.১৬ মিনিটে আমরা কর্নফুলী ব্রিজ পার করলাম। এখন শান্তির হাট ৩.২১ ঘড়িতে। ৪.২৯ মিনিটে আমরা ইনানী রিসোর্ট, হারবাং,চকরিয়া, কক্সবাজার রোডে। ৫.২৬ মিনিটে আমরা লামা বান্দরবান ইয়াংছা বাজারে আমাদের আইডি কার্ড কপি জমা দিলাম প্রশাসনের কাছে। ৬.১৮ লামায় আবারও সবার আইডি কার্ড কপি জমা দিতে হলো এবং কঠিন হুশিয়ারি আলীকদমের এককদমই আর বেশি যাওয়া যাবে না! অবশেষে ৭টায় আমরা আলীকদম বাসস্ট্যান্ডে।
১ম দিনের শুরু,
আলীকদম বাসস্ট্যান্ডে ডিম-ডাল-ভাত খেয়ে নিলাম সবাই। এখানে এখনো দোকান ঘাট খোলেনি বললেই চলে। আমাদের খাবার তৈরির উপকরণ মুদি মালামাল, খাবার পানি, প্রয়োজনীয় ঔষধ, ট্রেকিং করার উপযোগী জুতা কেনার জন্য আলীকদম বাজারে গিয়ে ১০টা নাগাদ কেনাকাটা করে পান বাজার হয়ে আমতলা টৈন খাল পথে বোটে যাওয়ার জন্য বোর্টের অপেক্ষায় প্রায় ৩-৪ ঘন্টা একটা জুম ঘরে শুয়ে-বসে গান গেয়ে কাটাতে হলো। ২টা থেকে ৫.৩০ পর্যন্ত বোটে বেশ কয়টি বোট পাখা ভেঙে পায়্যা পাড়া পৌছে এবার ঝিরি পথে রেম্বুক পাড়ার উদ্দেশ্যে হাটছি আমরা সবাই। যে গাইড আমাদের সাথে যাওয়ার কথা তিনি না গিয়ে অন্য একজন মুরং সম্প্রদায়েরর কিশোরকে দিয়ে সন্দেহাতীত ভাবে অনুসরণ করে চলেছি। এদিকে অন্ধকার নেমে আসছে ভয়ংকর ভাবে! ঘন গুটগুটে অন্ধকারে পাহাড় জঙ্গল পাড়ি দিচ্ছি দুই ঘন্টার অধিক! এখন বাজে ৭.৩১ মিনিট। ঘেমে সবার অবস্থা জবজবে। রিয়ার খুব খারাপ অবস্থা, ট্রাবেলিং ব্যাগ অনেক আগেই ছাপিয়েছে রায়হান জামানের কাধে। বন্টিত খাবারের কাচা মাল বহন বাদ দিয়েছে তারও আগে। আওলাদ হোসেনকে রিয়া খুব কাকুতি মিনতি করে সেই ব্যাগ হস্থান্তর বুঝিয়ে দিয়ে এক প্রকার হাঁপ ছেড়ে বেচেছে। মাঝেমধ্যে অল্পসময়ের বিরতিতে কৃষাণ বর্মন সাধু সঙ্গীতে কিছুটা হিমেল হাওয়া বয়ে স্বস্তি যুগিয়েছে। হাটতে হাটতে সুউচ্চ পাহাড় বেয়ে যখন সবার শ্বাস বাড়ি হয়ে নিশ্বাসের বন্ধের যোগার হয়, তখন এ-ই অল্প সল্প বিরতি শ্বাস সাভাবিক হতে সাহায্য করেছে। রাত ৮.৫ মিনিটে অন্ধকারে আশার আলো! পাহাড়ের চুড়ায় দাড়িয়ে নিচে যখন তনসঙ্গ পাড়ার বাতির আলোয় যেন নিঙড়ানো দেহে ঘাড়ে বালিশ পেয়েছি। আনন্দ অনুভব করলাম। কিন্তু মুহুর্তেই যেন “আশায় গুড়ে বালি” গাইড জানালেন এই পাড়ায়ও আমরা নামতে পারবো না। অবশেষে পাহাড়ের গভীর রাত ৯.৩০ মিনিটে আমরা ১ম দিনের ট্রেকিং শেষ করে সন্ধান পেলাম রেম্বুক পাড়ায়। এতো দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পাড়ায় এসেই দেখি গোসল তো দূরের কথা এখানে খাবারেরও পর্যাপ্ত পানি নেই। এমনিতে প্রায় সকলের শরীরে পানি শূন্যতা ভালোভাবেই কাবু করে ফেলেছে তার উপর পাড়ায় পানি নেই শুনে সবার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেছে। দুপুরের খাবার বলতে তেমন কিছুই খাওয়া হই নি। এবার খাবার কাচামাল আলু-চাল-ডাল-ডিম যা এনেছি তা দিয়ে পানিশূন্য পাড়ায় খাবার তৈরির যুদ্ধে নামতে হবে।
১ম রাত,
ক্লান্ত রিক্ত দেহে রাত ১টা অব্দি নিরংকুশ চেষ্টায় ১৪ জনকে ৭+৭ জন করে দুভাগে ভাগ করে, থাকার ব্যবস্থার বাস্তবতায় পাড়ার দুই প্রান্তের দুই জুম ঘর থেকে রান্নার পানি নিয়ে দুই ভাগে আলাদা ভাবে আমাদের খাবারের রান্না সম্পন্ন করে খাওয়া শেষ করতে ২টা প্রায়। খাওয়া শেষে কেউ নিজের মতো করে পাড়া ঘুরতে বেড়িয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জুম ঘর থেকে রাতে আর বের হবো না। সকাল পর্যন্ত ঘুম ঘুম শুধুই ঘুম ।
২য় দিন,
সকাল ৮.১৩ মিনিট ; আওলাদ, রাব্বি, উজ্জ্বল, সাদিক গাইডের সাথে ট্যুরের পরবর্তী পরিকল্পনা সভা করছে। তাদের চাপে আমাকেও উঠে বসতে হলো। উঠার পরে পরিকল্পনা যাইহোক এক নতুন বিড়ম্বনা, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া পাওয়া গেছে কিন্তু পাড়ায় কোথায় শৌচাগার নেই! একি বিব্রতকর পরিস্থিতি! তবে কিছু করার নেই। আপাত বিপদে সংকটকালীন পর্যাপ্ত পানি বরাদ্দ নিয়ে গভীর জঙ্গল ভ্রমণ প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে, একে একে সাড়া দিয়েও আসলাম। এক পিগ আরেক অভিজ্ঞতা দিলো, সাড়া শেষে নিজের মতো করে শোচাকার্য সম্পাদন করে কেউ কারো রেখে আসা উৎবৃত্ত মল চোখে দেখে নি।
সকাল ৮.৪৫ এবার খাবারের চাহিদা অনুভব করছে সবাই, যেহেতু হেতু পিগ কে খাইয়েছে সবাই। তা-ই আমদেরও কিছু খেতে হবে। গাইডকে ধরে সাথে নিয়ে আসা নুডলস রান্নার তোরজোড় শুরু হয়েছে। সকালের নাস্তা শেষ হাটা শুরু করে কয়েকটি পাহাড় বেয়ে আমরা দুপুর ১২টায় তৈনখাল এসে নামলাম। দীর্ঘ ৪ঘন্টার ঝিরিপথের তৈনখাল ট্রেকিং করে পাথরের পাহাড়ের চূড়ায় পালংকৈইর পাড়ায় এসে পাথরের গা বেয়ে আসা ঝিরিপথের প্রবাহের বিপরীতে শুয়ে-বসে গোসল নামক দীর্ঘক্ষনের ধারাবাহিক দেহ শীতল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে জুম ঘর ভাড়া নিয়ে উঠে বসলাম। রুম পাওয়া নিয়ে কিছুটা ঝামেলায় পরতে হয় একবার উঠে বসার পরও জায়গা নেই তা-ই বের হয়ে বিকল্প খুজতে হয়েছিল উলটা দিকে কিছু পথ যাওয়ার পর আমাদের গাইড জুম ঘরের পরিচালকের বাবাকে ধরে আবার থাকার ব্যাবস্ততা করা হয়। কারণ আমাদের সাথে লোক গাইডসহ ১৫ জন সুতরাং অনেক বড় দল সাথে তিনজন মেয়ে সহযোদ্ধারাও আছেন। রুম বিশেষ দরকার কিছুটা অতিরিক্ত দিয়েই তিন রুমে ৩, ৭, ৫ জন করে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে থাকার ব্যবস্থা করা গেল। এবার দুপুরের না খাওয়া খাবার ব্যবস্থাপনার যোগাড় যন্ত করতে হবে। আমাকেও ডাকছে গেলাম।
২য় দিনের সন্ধ্যা নেমে এসেছে ঝিরিতে ৬.৩০ মিনিটে আমরা দুপুরের রাতের দুই বেলার খাবার একবেলায় খিচুড়ি শুটকি আকারে পর্যাপ্ত খেয়ে নিলাম। এবার কৃষাণের পরাণ জুড়ানো গান, পাহাড় ঝিরি, চাঁদনী রাত আর জুম ঘর এক নৈস্বর্গীয় রুপ নিয়েছে।
৩য় দিনের সকাল,
৬.৩০ মিনিটে আমরা ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে আবারও সবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে একেএকে প্রকৃতির গহীনে হারিয়ে যেতে লাগলাম। এখানে অবশ্য কারো পিছু নেয়নি পিগ শিশু বড়রা, এটা একটা স্বস্থির ব্যাপার। ৭.৩০ মিনিটে নুডলস রান্না করে খেয়ে সবাই যার যার ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে ছুটেছি। পালংকৈ পাড়া থেকে টৈনকৈর টৈনখালের বিপরীতে হাটা শুরু করলাম ঝিরিপথে। প্রায় ১ ঘন্টা খানিক হেটে আমরা পৌছলাম কৃস্তং পাহাড়ের কৃস্তং পাড়া এবং রুংরাং পাড়ার মাঝখানে নিচে তৈন খালের সংলগ্ন একটা ছোট আন্ধার মানিক ভিউ পেয়ে গেলাম। দুই পাশে পাথরের পাহাড়ের মাঝে গভীর ঝিরিজ্বলে সাতার কাটা, বেলায় চড়া এক অজানা আনন্দে মাতিয়েছে আমাদের সবাইকে। তারপর আবার উল্টো হাটা শুরু হাজিরাম পাড়ার উদ্দেশ্যে। হাজী রাম পাড়ায় বিকাল ৫.৩০ মিনিটে পৌছে আগে থাকার জন্য নিরিবিলি এক পাহাড়ের চুড়ায় একটা জুম ঘর ভাড়া নিয়ে মালিক আদিবাসী গোষ্ঠী(নব্য খৃষ্টান) সাথে কথা বলতে গিয়ে জানলাম এখানে হাজীরাম পাড়ায় মিশনারী স্কুল আছে, তাদের ভালো প্রভাব আছে। মিশনারী স্কুলে হাই স্কুলে পড়তে হলে আলীকদম যেতে হয়। আলীকদমে বাৎসরিক ৪০ হাজার চুক্তিতে আবাসিক থেকে পড়া যায়। তিনিও একজন মিশনারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষক। তার জুমেই আজ আমরা থাকবো। রাতের খাবারের মেনু ঠিক করা হলো ডিম ভাজা, জুমের চালের ভাত, আলু ভর্তা, নাপ্পীর ঝাল ডগাশাক। এবার জুম ঘরে শুয়ে-বসে কৃষানের উদ্যোগে ইউকেলালে গানের আসর বসেছে। আওলাদ-রাব্বী কিছু পুরনো দিনের সিনেমার গান গেয়ে মাতিয়েছে। রিচার্ড মুগ্ধ করেছে অঞ্জন দত্তের ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস।
ডাক এসেছে, আমাদের গাইড জানালেন খাবার প্রস্তুত। আমরা খেতে গেলাম মাস্টার দা’র বাসায়। দুর্ভিক্ষের ক্ষুধার্থের মতো সবাই হামলে পড়েছে। নাপ্পীর ঝাল ডগা বাজা, আলুর ভর্তা, ডাল সাথে জুমের লাল চালের ভাত! সবাই নাক ডুবিয়ে খেয়েছে। তারপর ভরা পেটে পাহাড়ি খাসি খাওয়ার আবদার! যদিও পর্যাপ্ত আমিষ আমরা পাহাড়ে পাইনি। এখানে মুরগীও সচারাচর পাওয়া যায় না। যাইহোক সর্বসম্মতিতে ৩৫০০টাকায় ১৫ জন খাওয়ার উপযোগী একটা খাসি কেনা হলো। আমি এবং রায়হান জামান, সেটা রাতেই জবাই করে দিলাম। রাতের সব প্রস্তুত করা হবে। সকালে নাস্তায় ভাত খাসীর গোস্তো খাওয়া হবে।
খাওয়া দাওয়ার পরে সবাই মাস্টার দা’র পারিবারিক ঘর থেকে বের হয়ে আমরা আমাদের ভাড়া করা জুম ঘরে এসে আবার গানের আড্ডা শুরু হয়েছে। আসেপাশে আর্মি ক্যাম্প আছে তা-ই রাত ১১টার পর থেকেই পাড়ার কারবারি বারবার বাধঁ সাদছেন আমাদের গান বন্ধ করতে হবে। আমাদের গাইডকে তার মানা জানিয়ে পাঠাচ্ছেন। আমরা কিন্তু সাউন্ড কম করে গেয়েছি গান, শুনেছি কৃষানের আওলাদের রাব্বির মন মুগ্ধকর পরিবেশনা।
৪র্থ দিন,
সকালে ৭টায় আমরা রোদের উঞ্চতায় ঘুম থেকে উঠেই জানলাম মাস্টার দা’ ডাক পাঠিয়েছেন, খাসির রান্না বসাতে আমরা কেউ যাবো কি-না? আমরা জানিয়ে দিলাম দাদা যেন, উনার নিজের মতো করে রান্না করে দেন। আমরা এবার প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে খোঁজ খবর নিলাম। আহ্ স্বস্তি, আজকে অন্তত চারপাশে ঢাকা একটা ওয়াশরুম পাওয়া গেল! সবাই হাতমুখ ধুয়ে আসতেই শুনলাম দাদা রান্না শেষ করে ফেলেছেন! এর মধ্যে অনেকে আদিবাসী দোকানে অনেক কিছু খেয়ে ফেলেছেন। রান্না হয়েছে শুনে সবাই তাড়িয়ে চলে গেলাম দাদার জুম ঘরে। দাদা সবাইকে খাসির গোস্তো আর ভাত পরিবেশেন করলেন। খুবই সুস্বাদু খাবার রান্না করেছেন দাদা। পুরোপুরি খাসির স্যুপ যেন! আমরাও সাধ্যমতো সবার খাওয়ার পর শুনি দাদা, আমাদের জন্য রঙ চাও বানিয়েছেন। সবাই চা পান করলাম, চায়ের সাথে চা-লফি (সেলফি) তুললাম।
খেয়ে দাদার কাছ থেকে বিদায় নিলাম ১০টার দিকে। রওনা হলাম তানকৌয়াং পাড়া। তানকৌয়াং ঝর্ণায় পৌছালাম আস্তে-ধীরে ১১.৩০ এর কাছাকাছি সময়ে। যদিও সবাই এখনো পৌছেনি, আমি কিন্তু ঝর্ণার লোভ সামলাতে না পেরে ব্যাগ কাধ থেকে ফেলেই দিলাম লাফ! ওরে বাবা, নাক বাচিয়েও ঠাই পাওয়া যাচ্ছে না! যারা সাতার কাটতে পারে তারাই শুধু পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করতে পারবে।
তানকোয়াং ঝর্ণায় গোসল, ঝর্ণা থেকে লাফিয়ে পরা সাতার কাটা সব কিছু একসাথে করে ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে আমরা ছুটলাম ঝিরিপথের প্রবাহের দিকে রাঈমনি পাড়া হয়ে দুছড়ি বাজার।
দুছড়ি বাজার আমরা ২টা নাগাদ পৌছে হালকা নাস্তা করে ছুটলাম তৈনখাল পাড় হয়ে ম্যান কিউ পাড়া হয়ে ম্যানপাও পাড়ার পৌছালাম আস্তে-ধীরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। সেখানে পাহাড়ের উপর আরও একটা পাড়া ছিল অনেক উচুতে। সেখানে আমরা রাতে গানে ঘাটি গাড়তে ছেয়েছিলাম কিন্তু গাইড বাধ সাধলেন! সেখানে না-কি পানি অপর্যাপ্ততা আছে। আমাদের টিম বড় সুতরাং সবাইকে হাত ধোঁয়া, খাবার এবং প্রাকৃতিক সাড়ায় পানি দিতে পারবে না। তা-ই সেখানে উঠার সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে নিচে মেম্বার পাড়ায় থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। এখানে পাশেই তানকোয়াং ঝর্ণার প্রবাহিত পানির ঝিরিপথ আছে। প্রয়োজন মতো সহজেই এখান থেকে ব্যবহার করতে পারবে। আদিবাসী মরং মেম্বার পাড়ায় থাকার ঘর ভাড়া নিয়ে,
রাতে আমরা পাহাড়ি মুরগী কিনলাম দুই টা সেগুলো রান্না হবে, সাথে খিচুড়ি।
একদিকে রান্নার প্রস্তুতি চলছে, অনেকে পাশের পাহাড়ের চুড়ায় জুম ঘর টা দেখতে গিয়েছে। কেউ পিয়াজ, রসুন,আদা, আলু কাটছে, কেউ মুরগী। কাটাকুটি শেষ করে ঝাল মুড়ি মাখানো হলো, সবাই সবাইকে ডেকে নিয়ে বসলাম মুড়ি মাখানো খেতে খেতে শুরু হয়েছে কৃষাণের গান। কেউ কেউ খিচুড়ি ‘র রান্না ব্যবস্থাপনা সেরেছে, চুলোয় চাপিয়েছে খিচুড়ি। গান চলছে, কেউ আবার অঞ্জন দাদার সাথে কাজ ফাকি দিয়ে ঘুমাচ্ছে নাক ডেকে। আমরা বাইরে গিয়ে বেরিয়ে আসলাম। ৮.৩০ অব্দি খিচুড়ি রান্না সম্পন্ন এবার মুরগী রান্না করছেন বিপ্লব ভাই সাথে পপি কেটেকুটে সহায়তা করেছেন। ঘন্টা খানিক পরে রান্না শেষ হবে এ-র মধ্যে আমাদের গানের আড্ডাও চলছে। উপরের পাড়ায় থাকতে না পেরে কেউ কেউ মন খারাপ করেছে আমার মতো। ৯.৩০ মধ্যেই আমাদের খাবার প্রস্তুত। আমরা খেতে বসলাম, মুড়ি আমাদের খিদে কিছুটা মাড়িয়ে দিয়েছে। তার সাথে খিচুড়ি – মুরগী দুটোই সবে চুলা ছাড়লো কিন্তু খেতে হবে দ্রুত এ যেন, অবুঝ ক্ষুধার্ত শিশু সব। খিচুড়ি খুব সুস্বাদু তবে একটু বেশিই ঝাল হয়েছে। পাহাড়ি লাল মরিচের ঝাঁজ সহ্য করা কষ্টকর তা-ই সাধ্যমতো সবার খাওয়ার মুরগী’র পিচেস অব্দি অতিরিক্ত খিচুড়ি কেউ খেতে পারলো না।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই যথারীতি কৃষাণের গানে মুগ্ধ হতে চেয়েছিলাম কিন্তু হলো কৃষাণ বর্মন আজ গোড় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তাই বিপ্লব ভাই অদ্ভুত সব খেলা বের করেছেন। যা চলেছে প্রায় সারারাত। তারপর প্রায় সকালের আগে আগেই আমরা ক’জন ঘুমাতে পারলাম উঠতে উঠতে সকাল ৮.৩০ মিনিট।
৫ম দিন,
আওলাদ ভাই আমাদের সকালের নুডলস রান্না শেষ করেছেন। নিজেরা নিজেদের মতো প্রাকৃতিক বাস্তবতায় সাড়া সম্পন্ন করে ঝিরেতে হাতমুখ ধুয়ে আসতেই নাস্তা হাজির। খাওয়া শেষ করে আমাদের যাত্রা হবার কথা ছিল ১৩ কিলো রাস্তা। কিন্তু তা হলো না, রাতে ঘুম না হওয়ায় দীর্ঘ পথ হাটার স্টেমেনা হারিয়েছে কয়েকজন। তা-ই উল্টো পথে দুছড়ি পাড়া ফিরে যেতে হবে। সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে আলীর গুহায় যাওয়া হবে। ঘন্টা ২ঘন্টা আস্তে-ধীরে হেটে আমরা দুছড়ি বাজার পৌছালাম ১২টা নাগাদ। আমাদের গাইডকে বিদায় জানাতে তার পারিশ্রমিক দিতে গেলে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। গাইড জানালেন তাকে চুক্তির অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে প্রতিদিন হিসেবে ২০০০ করে, অথচ পাড়ার নিয়ম অনুযায়ী ১৫০০ দৈনিক নির্ধারিত। যাইহোক গাইড নতুন হওয়ায় তাকে কেউ বুঝাতে সামর্থ্য হচ্ছিলো না। তাই তাকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিয়েই আমরা বিদায় নিলাম। ২০ মিনিট গাড়ির অপেক্ষা করে দেখি গাড়ি আসা অব্দি ২০মিনিট আরও কয়েক দফা যাবে। এভাবে পাড়ার দোকানে দোকানে ঢু মেরে বেজেছে ২.৩০টা আমাদের চান্দের গাড়ি এসেছে।
তৈনখাল পাড় হয়ে আমরা উঠে বসলাম গাড়িতে। ভয়ংকর সুন্দর খুবই খাড়া ওঠা-নামার ভাঙা ছোড়া গিরিখাদের পার্শপথ। আমি অবশ্য অতি উৎসাহ নিয়ে চান্দের গাড়ির সামনে ইঞ্জিনের উপর বসে ট্রাভেলিং করছিলাম। ভয়-আনন্দ-অবিভূত হওয়ার মতো এক পথ। আলীকদম পোছানোর আগেই চেকপোস্টে আর্মিরা আমাদের আটকালেন। ড্রাইভার কে ধরে নিয়ে গেলেন, কিছুটা উত্তম মধ্যম দিলেন। পরে জানলাম আমি এবং তার হেলপার একজন উপরে বসে যে আনন্দটা নিচ্ছে তাতেই তাদের এতো ঈর্ষা। এ-ই কার্য আবার আইনত সিদ্ধ নয়। জীবনহানীর ভয় আছে। তা-ই না-কি শাসন করলেন। আমরা আর্মিদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ড্রাইভার কে নিয়ে আসলাম। সে আমাদের ও তার হেলপারের সাথেও কিছুটা রাগারাগি চেঁচামেচি করলেন আমরা উনাকে কিছু আপ্যায়ন করে ঠান্ডা করলাম। আমরা পান বাজার হয়ে আলী কদমের কাছাকাছি। তিনি আমাদের আলীর গুহার কিছুটা আগেই নামিয়ে দিয়ে দুইটা অটোরিকশা ঠিক করে দিলেন। পার হেড ১০টাকা করে ভাড়ায় অটোরিকশায় চড়ে আমরা আলীর গুহার বাহিরে ব্রিজে নামলাম। অটোরিকশার চালক ভাই বললেন একজন গাইড নিয়ে যেতে। আমরা ৯-১০ বছর বয়সী মোবারক কে নিয়ে নিলাম গাইড হিসেবে। সে এখানকার স্থানীয়। সে আমাদের গাইড দিয়ে দেখিয়ে দিল পথ। প্রথমে ঝিরিপথের প্রবাহের পর দেখি দু’পাশে পাথরের বিশাল বিশাল পাহাড় দাড়িয়ে আছে মাঝে সিঙ্গেল হাটা পথে দুপাশের পাহাড় ধরে উঁচুনিচু পাথুরে গিরিপথ পেরিয়ে এসে আবার খাড়া খুবই বিপদজনক সহস্রাধিক বছরের পুরনো বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা কৃত্রিম বেয়ে উঠা পথে উঠে কিছুটা হেটে আমরা পেয়ে গেলাম ১ম গুহার সুরঙ্গপথ। এটা খুবই সরু প্রবেশপথ, ব্যাগ কাধে নিয়েও ঢোকা সম্ভব না। আমরা ব্যাগ আমাদের গাইড মোবারককে দেখিয়ে রেখে সুরঙ্গের মধ্যে একেক করে ঢুকতে লাগলাম। রিয়া – পপি’দি কিছুটা ঢুকেই বের হয়ে চলে আসলেন। বললেন তাদের ধম বন্ধ হয়ে আসছে তা-ই তারা গুহায় ঢুকবে না। এটা শুনে বেশ ক’জন আর ঢুকার সাহস দেখানোর চেষ্টা করেনি। আমরা যারা সাহসীরা একেক করে ঢুকতে লাগলাম ঢুকেই তো আশ্চর্য! শুধু ঢোকার মুখ টা-ই বেশি ছোট! ঢোকার পরে মোটামুটি দাড়ানো যায়। এখানে ভিতরে আরও কয়েকটি গুহা আছে একেকটা মনে হয় একেক স্থরের সাধকদের সাধনায় ব্যবহার হয়েছিল কোন একসময়। এখনো ভিতরে ঢুকলে মন ঘেমে যায়, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা অকপটে স্বীকার করতে হয়। আল্লাহু আকবর। এতো বড় পাথুরে পাহাড় কে কিভাবে কতোদিনে বানালেন আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। আলহামদুলিল্লাহ।
গুহার শেষ প্রান্তে আছে একজন বসে ধ্যান করার মতো পাথরের আসন। সেখানে বসলেই বাতাস, সুর্য্যের আলো, চাদের রশ্মি সব যেন সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিচ্ছুরণ হচ্ছে এমন অলৌকিক কাঠামো গঠন শৈলী। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ-ই অপুর্ব নিদর্শন দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। আরও অসংখ্য বার আসার ইচ্ছা নিয়ে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম। এখন আলীকদম বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ৭টার বাসে আমরা ঢাকায় অথবা বাসায় ফিরবো। এবারের মতো শেষ করছি, আবারও হয়তো কোনো ভ্রমণ ডায়েরি তে কথা হবে।