অতি বর্ষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ধস-বন্যার সতর্কতা

কক্সবাজার উপকূলকে বাঁয়ে রেখে ডানে মিয়ানমারকে আঘাত করেছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। ‘মোখা’র প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলের আবহাওয়ায়। ‘মোখা’র পিঠে প্রচুর মেঘমালা ও জলীয়বাষ্প ছুটে আসছে। আজ সোমবার থেকে স্থানভেদে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় সারা দেশে কমবেশি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এর ফলে টানা দেড়-দুুই মাসের উচ্চ তাপমাত্রা, খরা কেটে যাচ্ছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও কক্সবাজার অঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। অতি বর্ষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক জায়গায় পাহাড়ধস বা ভূমিধসের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া কোথাও কোথাও পাহাড়ি খরস্রোতা নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর জন্য গতকাল বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া বিভাগ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশপাশে পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসরত লোকজনদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন টিম। তবে অনেক জায়গায় এখনও বিশেষত হতদরিদ্র শ্রেণির ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দারা রয়েই গেছে। এর পেছনে আছে ভূমিদস্যু ও পাহাড়খেকো সংঘবদ্ধ চক্র। অতিবৃষ্টিতে অকস্মাৎ একেকটি স্থানে নড়বড়ে পাহাড়-টিলা ধসে গিয়ে তাদের জানমাল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া গতকাল পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানান, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় (বৃহত্তর চট্টগ্রাম) উপকূলীয় এলাকা ও পার্বত্য অববাহিকার স্থানসমূহে এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ জায়গায় মাঝারি থেকে ভারী এমনকি অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

ওই সময়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকায় অবস্থিত মুহুরী, হালদা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, বাঁকখালী, নাফ নদীসমূহের পানির সমতল সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে করে এই অববাহিকাসমূহের কতিপয় নিম্নাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার অনেক জায়গা আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ‘মোখা’র পরবর্তী প্রভাবে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে কক্সবাজার সদর, রামু, টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার অনেক জায়গা আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের ‘সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে। অন্যদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস বা পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে থাকা জেলা-উপজেলার এলাকাগুলোতে বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ খুবই অপ্রতুল। অনেক জায়গায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কার্যত নির্বিকার।

‘মোখা’ যেভাবে এলো আর গেলো : ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র কেন্দ্র বা চোখ এবং বডি প্রধানত মিয়ানমারের দিকেই সরে কেটে গেছে। মূল প্রভাব পড়েছে উত্তর মিয়ানমারের সিটুইয়ে-কিয়াকপু এলাকায়। ঝুঁকিমুক্ত ছিল বাংলাদেশ। যদিও দুর্বল, হালকা ও সীমিত প্রভাব পড়েছে টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ-সেন্টমার্টিন এলাকায়। বিকেলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঝড়ো বাতাসের গতিবেগ ছিল সর্বোচ্চ ১৪৭ কি.মি.। ‘মোখা’ কক্সবাজারকে বাঁ পাশে রেখে ওপারে উত্তর মিয়ানমারের সিটুইয়ে (সাবেক আকিয়াব বন্দর-উপকূল) ও কিয়াকপু অতিক্রম করে গেছে। এটি ক্রমেই ধেয়ে আসে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর হয়ে উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের দিকে মিয়ানমারে গতিমুখ বজায় রেখে। অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী চর-দ্বীপাঞ্চলের জনগণ। আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।

ভারতের আবহাওয়া বিভাগের (আইএমডি) ঘূর্ণিঝড় বিজ্ঞানী ড. আনন্দ কুমার দাশ সর্বশেষ বুলেটিনে গতকাল জানান, ‘মোখা’ উত্তর, উত্তর-পূর্বমুখী গতিপথ বজায় রেখে উত্তর মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল দিয়ে সিটুইয়ে’র (সাবেক আকিয়াব) কাছে কক্সবাজারের বিপরীত দিকে মিয়ানমারের কিয়াকপু অতিক্রম করেছে। গতকাল বেলা একটা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে উপকূলে আঘাতের আগে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আকারে ‘মোখা’র গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮০ থেকে ১৯০ কি.মি.। যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২১০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

তবে উপকূলে আছড়ে পড়ার সময়ের তিন ঘণ্টাকালে ‘মোখা’ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬০ থেকে ১৭০ (দমকা বা ঝড়ো হাওয়া আকারে ১৮৫) কি.মি. এবং ১৩০ থেকে ১৪০ কি.মি. (দমকায় ১৫৫)। পরবর্তী সময়ে ‘মোখা’ গভীর নিম্নচাপ ও নিম্নচাপ আকারে ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কি.মি. গতিতে স্থলভাগের দিকে সরে গিয়ে আরো দুর্বল হয়ে যেতে থাকে।

আবহাওয়া বিভাগের বিশেষ বুলেটিনে (২১ নম্বর) মো. হাফিজুর রহমান জানান, উপকূল অতিক্রমরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে সামান্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০, যা দমকায় ১৩০ কি.মি.। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র গতকাল বিকাল ৩টায় সিটুইয়ের কাছ দিয়ে কক্সবাজার ও উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করে এবং মিয়ানমারের স্থলভাগের ওপর অবস্থান করছে। এটি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *