জঙ্গল সলিমপুরে ২৪ হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করে পার্ক নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে
জাহিদুল আলম আল-জাহিদ, সম্পাদক ও প্রকাশক:
১১ সেপ্টেম্বর ২০২২,
জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল ভূমিহীন কল্যাণ পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল ভূমিহীন কল্যাণ পরিষদ
রাজধানীতে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল ভূমিহীন কল্যাণ পরিষদ। তারা বলছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গল সলিমপুরে প্রায় ২৪ হাজার ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ করে সাফারি পার্ক নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরিষদ ওই সংবাদ সম্মেলন করেছে।
রোববার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন জাতীয় মানবাধিকার সমিতির সভাপতি মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, আগামী সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন তাঁরা। ভূমিদস্যুদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। সেখানে এতগুলো পরিবারকে তাদের দীর্ঘদিনের আবাস থেকে উচ্ছেদ মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে এ অন্যায়ের প্রতিকার করতে হবে।
জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল ভূমিহীন কল্যাণ পরিষদ বলছে, হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ২৪ হাজার ভূমিহীন পরিবার উচ্ছেদ করে নাইট সাফারি পার্ক নির্মাণ করার চেষ্টা করছে একটি মহল। এ কাজে তাদের সহায়তা করছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। ৮ সেপ্টেম্বর সেখানে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এতে আহত হয়েছেন সেখানকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা।
ওই পরিষদ আরও বলছে, বছরের পর বছর পাহাড় কেটে জায়গাটিকে বসবাসের উপযোগী করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। ২০১০ সাল থেকে সেখানে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রায় ১২ হাজার ভোটার বাস করছেন সেখানে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্তানেরা স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। ১৫ সেপ্টেম্বর ৩৫০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবে। এলাকায় ১০টি কিন্ডারগার্টেন, ১৫টি মাদ্রাসা, ১৮টি মসজিদসহ রয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, বাজার, মাজার, গোরস্তান, শ্মশান। এ রকম একটি জায়গার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে নাইট সাফারি পার্ক নির্মাণ করা অন্যায়।
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদ বলেছে, গত বছরের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন যে জঙ্গল সলিমপুরের ২৪ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করা যাবে না। অথচ উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ২২ দিন এলাকাটি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। ওই এলাকায় পুলিশ, র্যাব, ম্যাজিস্ট্রেট তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে প্রায় তিন হাজার মানুষ চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করলে সীতাকুণ্ডের উপেজলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে বিদ্যুৎ–সংযোগ স্বাভাবিক হয়। কিন্তু পরে একটি পরিকল্পিত দুর্ঘটনায় ৪৫ জনকে এজাহারভুক্ত করে ৮৮৫ জনকে আসামি করে ৭টি মামলা করে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এস এম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম সালাম, মানবাধিকারকর্মী রফিকুল ইসলাম সম্রাট, জাতীয় মানবাধিকার সমিতির সভাপতি মনজুর হোসেন, স্থানীয় বাসিন্দা চিকিৎসক জামাল উদ্দিন প্রমুখ।
জঙ্গল সলিমপুর—‘বড় কিছুর’ তোড়জোড়, ‘হাইপ্রোফাইল’ সভা চট্টগ্রামে
জঙ্গল সলিমপুর—‘বড় কিছুর’ তোড়জোড়, ‘হাইপ্রোফাইল’ সভা চট্টগ্রামে
জঙ্গল সলিমপুরকে ঘিরে মহাপরিকল্পনার প্রস্তাবিত নকশা
চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুরকে ঘিরে ‘বড় কিছুর’ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের ‘মহাপরিকল্পনার খসড়া’ এবার পৌঁছেছে জাতীয় পর্যায়েও।
ইতোমধ্যে সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রস্তাবিত এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখেছেন। সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তারাও। এর পর-পরই আলোচনায় উঠে আসে জঙ্গল সলিমপুরকে ঘিরে মহাপরিকল্পনার কথা। সর্বশেষ এ বিষয়ে ‘হাইপ্রোফাইল’ এক সভা হয়েছে চট্টগ্রামে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কেটে ভূমিদস্যুরা অপরাধের আস্তানা গড়ে জঙ্গল সলিমপুর এলাকায়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ৩ হাজার ৭০ একরের খাস জমিতে অবৈধ বসতি হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার। আর এসব নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মোট ১৩টি সিন্ডিকেট, যা মূলত ছিন্নমূল সংগ্রামী বস্তিবাসী সমন্বয় পরিষদ ও আলীনগর ভূমিহীন সমবায় সমিতির ছত্রছায়ায় পরিচালিত হয়।
এ অবৈধ বসতির জায়গায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যালয় গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। এর অংশ হিসেবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এলাকাটি পরিদর্শন করেন।
শনিবার (৩০ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে পুরো বিষয়টির বর্ণনাসহ মহাপরিকল্পনার খসড়া তুলে ধরা হয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের কাছে।
জঙ্গল সলিমপুরের গড়ে ওঠা বসতি প্রসঙ্গে জানানো হলে মুখ্য সচিব কায়কাউস বিদ্যুতের খুঁটি ও সংযোগ কীভাবে গেল তা জানতে চান।
বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চট্টগ্রাম জোনের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলেও এটি সত্য যে, এ এলাকায় বৈদ্যুতিক সংযোগ যাওয়ার কথা না। কিন্তু আগে এ সংযোগ যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক তদবির ছিল। বলা হয়েছিল, ওখানে বেশ কিছু বসতি হয়েছে, তাদের যেন বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয়। তবে গত ২৪ জুলাই মাননীয় ভূমিমন্ত্রীর আদেশে ওখানকার বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
মুখ্যসচিব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর প্রসঙ্গ তুললে চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন ও জেলা পুলিশ সুপার এস এম রাশেদুল হক জানান, ওই এলাকায় পুলিশের একটি ক্যাম্প রয়েছে। কিন্তু ওই ক্যাম্পে ছয় জনের বেশি থাকার জায়গা নেই। তখন মুখ্যসচিব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিলে তারা ৪০ জন পুলিশ সদস্য রাখার ব্যবস্থা করার কথা জানান।
একই প্রসঙ্গে র্যাব-৭-এর অধিনায়ক এম এ ইউসুফ জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ওখানে মশিউরসহ মোট পাঁচজনকে অভিযানের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মশিউরের জেল হলেও তার সঙ্গীরা ছাড়া পেয়ে যান। এভাবে ইয়াছিনের সঙ্গে যে চারজনকে আটক করা হয়েছিল, তারাও জামিনে বেরিয়ে যান। এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুবিধা হতো।
এছাড়া র্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্পের জন্য ভূমি বরাদ্দের কথা বলায় মুখ্যসচিব বলেন, এটাতো পুরো খাস জমি। বরাদ্দের কিছু নেই।
পরবর্তীতে র্যাব-৭-এর অধিনায়ক বলেন, জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শন করে অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হবে।
সভায় মহাপরিকল্পনার প্রাথমিক একটি খসড়া নকশা উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি পাহাড়ি এলাকা বলে পাহাড়ি পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি স্পোর্টস ভিলেজ, জনসাধারণের চিকিৎসার জন্য হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, একটি সাফারি পার্ক, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, উচ্চ শক্তির বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কাস্টমস ডাম্পিং হাউজ, সবুজ শিল্প এলাকা, তথ্য কমপ্লেক্স, আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ ও অবৈধ বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও বিএমএ ওই এলাকায় জায়গা চেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সরকারি কাজে বাধা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি করার অভিযোগ করা হয়েছে এসব মামলায়।
চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুরে উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধে স্থানীয়রা।
সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের বাসিন্দাদের ভূমির স্থায়ী বন্দোবস্ত ও পানি-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়েছে।
সীতাকুণ্ড থানায় পুলিশের করা এসব মামলায় নারী-পুরুষসহ প্রায় ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বলেন, “পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুরসহ দুটি ঘটনায় ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও অনন্ত দেড়শজনকে আসামি করা হয়েছে এসব মামলায়।”
সরকারি কর্তব্য কাজে বাধা, বিস্ফোরক, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাগুলা করা হয়েছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
মঙ্গলবার প্রায় চার ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে ভূমির স্থায়ী বন্দোবস্ত ও পানি-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের দাবি জানায় সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের বাসিন্দারা।
তাদের বিক্ষোভের কারণে মহাসড়কে আটকা পড়ে বিভিন্ন শিল্প কারখানার পণ্যবাহী হাজারো যানবাহন। বাসে, ব্যক্তিগত গাড়িতে আটকে পড়া হাজার হাজার নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হয়।
জঙ্গল সলিমপুর: মহাসড়ক অবরোধ দিনভর ভোগান্তি, উচ্ছেদে অনড় প্রশাসন
জঙ্গল সলিমপুরে হবে কারাগার স্টেডিয়াম, সঙ্গে ‘ছিন্নমূলদের’ পুনর্বাসনও: তথ্যমন্ত্রী
জঙ্গল সলিমপুরে টানা অভিযান, বাসিন্দাদের বিক্ষোভ
শেষ পর্যন্ত তাদের সরিয়ে সড়কে যান চলাচল শুরু করতে বল প্রয়োগ করতে হয় পুলিশকে। সে সময় পুলিশের সাথে অবরোধকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে।
জঙ্গল সলিমপুরের বাসিন্দাদের দাবি, ওই এলাকার দুই অংশ ছিন্নমূল ও আলীনগরের সব বাসিন্দাকে সরকারি খাস জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে সেখানে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে প্রশাসন বলছে, প্রকৃত ভূমিহীনদেরই শুধু পুনর্বাসন করা হবে।
গত প্রায় দুমাস ধরে সলিমপুরের বাসিন্দাদের সাথে প্রশাসনের বিরোধ চলছে। সেখানে আলীনগরে অবৈধ বসতি উচ্ছেদে এখন পর্যন্ত নয় বার অভিযান চালানো হয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয় পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ।