শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন

রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করা হয়েছে। শনিবার বেলা ১২টায় অপরূপ নির্মাণশৈলীর দৃষ্টিনন্দন এ টার্মিনাল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে ঢাকার আকাশপথে সম্ভাবনার নবদিগন্ত উন্মোচিত হলো।

বিভিন্ন স্পটে আলোকচিত্রে বিমান ও বিমানবন্দরের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী এগুলো অবলোকন করেন। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে নানা বিষয়ে ব্রিফ করেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান।

বিমানবন্দরের এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে থার্ড টার্মিনাল প্রাঙ্গণের অনুষ্ঠানস্থলে পৌছান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এসময় প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো অডিয়েন্স দাঁড়িয়ে সংগীতের সঙ্গে ঠোঁট মেলান।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান। আরও বক্তব্য দেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, বিমান সচিব মেকাম্মেল হোসেন প্রমুখ।

পরে থার্ড টার্মিনাল, বিমান ও বিমানবন্দরের উন্নয়নের ওপর একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। বেবিচকের কার্যক্রমের ওপরও একটি ডকুমেন্টরি দেখানো হয়।

অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিব হাসান, জাপান ও জাইকার প্রতিনিধি, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যসহ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেন।

অতিথিদের বক্তব্যের পর প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে খুলেছে ঢাকার আকাশ পথে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।

জানা গেছে, সফট ওপেনিংয়ের পর বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইট তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করে ঢাকা ত্যাগ করবে। সেই ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করবে রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ বিমান। এই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের প্রস্তুতি হিসাবে বিমানবন্দরে চলছে মহড়া। এ টার্মিনালের একাংশে ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। টার্মিনাল-৩ এর পার্কিং বে-তে প্রথমবারের মতো ফ্লাইটে যাত্রী তুলেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট।

সোমবার বিমানের ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু রুটের ফ্লাইটটি (বিজি-৩৭১) প্রথমবারের মতো তৃতীয় টার্মিনালের হাই-স্পিডি ট্যাক্সিওয়ে দিয়ে পার্কিং বে-তে প্রবেশ করে। পার্কিং বে-তে অবস্থানের পর তৃতীয় টার্মিনালের বোর্ডিং ব্রিজ দিয়ে ফ্লাইটে ওঠেন কাঠমান্ডুর যাত্রীরা। ফ্লাইটটি বিমানের বোয়িং-৭৩৭ মডেলের ‘ময়ূরপঙ্খি’ নামের একটি এয়ারক্রাফট নিয়ে পরিচালিত হয়।
বৃহস্পতিবার একইভাবে টার্মিনাল-৩ ব্যবহার করেছে বিমানের ঢাকা-কাঠমান্ডু রুটের আরেকটি ফ্লাইট।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শফিউল আজিম যুগান্তরকে বলেন, হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ এর সফট ওপেনিংয়ের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সম্পূর্ণ প্রস্তুত। টার্মিনাল-৩ এর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য নতুন ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে।
থার্ড টার্মিনাল প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মুফিদুর রহমান বলেন, আমরা বলতে পারি তৃতীয় টার্মিনালটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে একটি এভিয়েশন হাব হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম মাইলফলক।’

অপরূপ নির্মাণশৈলীর দৃষ্টিনন্দন শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের একটি অংশের যাত্রা শুরু হলো। এর মধ্য দিয়ে ঢাকার আকাশপথে সম্ভাবনার নবদিগন্ত উন্মোচিত হলো।

তবে এসব সেবা পাওয়া যাবে ২০২৪ সালের শেষদিকে। এখন তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করা হলেও যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক অনেক কাজ বাকি, যা শেষ করতে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

নতুন টার্মিনালের ৯০ শতাংশ কাজ সফট লঞ্চিংয়ের জন্য সম্পন্ন হয়েছে এবং শনিবার থেকে এয়ারলাইন্সগুলো টার্মিনালের নতুন পার্কিং বে ব্যবহার করতে পারবে। সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন এবং ক্যালিবারেশন তৃতীয় টার্মিনালটি আগামী বছরের শেষে যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণ চালু হবে।

নতুন টার্মিনালটি বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা এবং যাত্রী পরিষেবা দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি পালটে দেবে। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলোসহ থার্ড টার্মিনালের ফ্লোর এবং সিলিংয়ে নজরকাড়া প্যাটার্নের বৈশিষ্ট্যগুলো খুবই পরিশীলিত।

তৃতীয় টার্মিনালটি একটি মাল্টিমোডাল পরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে যাতে যাত্রীরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ এবং প্রস্থান করতে সক্ষম হয়। নতুন টার্মিনালটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ভূগর্ভস্থ রেলপথ (এমআরটি-৫, কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর অংশ) এবং একটি ভূগর্ভস্থ টানেলের মাধ্যমে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এছাড়া আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের মাধ্যমে হজযাত্রীরা তৃতীয় টার্মিনালে যেতে পারবেন।

তৃতীয় টার্মিনালটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের অধীনে একটি জাপানি কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তৃতীয় টার্মিনালের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমের আগে বিভিন্ন বিদেশি এয়ারলাইন্স ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে চায়, যা দেশের এভিয়েশন সেক্টরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কত তলা: তৃতীয় টার্মিনালটি তিন তলা বিশিষ্ট।

প্রথম তলা: ব্যাগেজ  হ্যান্ডেলিং সিস্টেম, ভিভিআইপি, ভিআইপি ইত্যাদি।

দ্বিতীয় তলা: বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, বোর্ডিং ব্রিজ।

তৃতীয় তলা: বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, বিদেশগামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, চেক ইন কাউন্টার, সিকিউরিটি সিস্টেম ইত্যাদি।

ভিভিআইপি যাত্রীদের জন্য: তৃতীয় টার্মিনালে ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা করে বিশেষ ব্যস্থাপনা থাকবে। টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে  ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে এই আয়োজন।

টার্মিনালের আয়তন: তৃতীয় টার্মিনালের আয়তন  ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গ মিটার। বর্তমান দুটি টার্মিনালের আয়তন  এক লাখ বর্গ মিটার।

ট্রানজিট: ট্রানজিট যাত্রীরা প্রধান বহির্গমন লাউঞ্জ ব্যবহার করবে, যার আয়তন ৪০ হাজার বর্গ মিটার।

যাত্রী ধারণ ক্ষমতা: তৃতীয় টার্মিনালের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা বছরে এককোটি ৬০ লাখ। বর্তমানে দুটি টার্মিনালে বছরে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৮০ লাখ।

আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট: তৃতীয় টার্মিনালে যাত্রীদের লাগেজ বেল্ট  থাকবে ১৬টি। বর্তমানে দুটি টার্মিনালে লাগেজ বেল্ট আছে ৮টি।

আগমনী যাত্রীদের জন্য কাস্টম: বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে ৬টি চ্যানেল থাকবে।

চেক ইন কাউন্টার: তৃতীয় টার্মিনালে চেক ইন কাউন্টার থাকবে  ১১৫টি,  এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি।

ইমিগ্রেশন কাউন্টার: তৃতীয় টার্মিনালে ইমেগ্রেশন কাউন্টার মোট  ১২৮টি। এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয়  ১৫টি। মোট ১২৮টি কাউন্টারের মধ্যে বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি, আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি এবং ভিভিআইপি ৩টি।

বোর্ডিং ব্রিজ: বর্তমান দুটি টার্মিনালে আছে ৮টি বোর্ডিং ব্রিজ। তৃতীয় টার্মিনালে প্রথম পর্যায়ে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত করা হবে।

লিফট: ৪১টি। এরমধ্যে প্যাসেঞ্জার লিফট ৩৪টি ও সার্ভিস লিফট ৭টি

এসকেলেটের: ৩৫টি, মুভিং ওয়াকওয়ে: ১৪টি

হোল্ড ব্যাগেজ এক্সরে মেশিন: ২৭টি, কেবিন ব্যাগেজ  এক্সরে মেশিন: ৪০টি

বডি স্ক্যানার: ১১টি, মেটাল ডিটেক্টর: ৫২টি

উড়োজাহাজ পার্কিং বে: বর্তমানে আছে ২১টি। তৃতীয় টার্মিনালে পার্কিং বে রয়েছে ৩৭টি।

মাল্টি লেভেল কার পার্কের ধারণ ক্ষমতা: বর্তমানে বহুতল কার পার্কি ভবনে ৩০০টি গাড়ি রাখা সম্ভব। তৃতীয় টার্মিনালের কার পার্কিংয়ে ১২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে।

আমদানি কার্গো ভবনের আয়তন: বর্তমান কার্গো ভবনের আয়তন ১৩ হাজার ৭০০ বর্গমিটার।  নতুন টার্মিনালের ভবনের আয়তন  ২৭ হাজার বর্গমিটার।

আমদানি কার্গো ভবনের ধারণ ক্ষমতা: বর্তমান ভবনের ধারণ ক্ষমতা বছরে ৮৪ হাজার ৩৭৯ টন। নতুন ভবনের ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ৭৩ হাজার ৪৭০ টন।

রফতানি কার্গো ভবনের আয়তন:  বিদ্যমান ভবনের আয়তন ১৯ হাজার ৬০০ বর্গমিটার। নতুন ভবনের আয়তন ৩৬ হাজার বর্গ মিটার।

রফতানি কার্গো ভবনের ধারণ ক্ষমতা:  বর্তমানে বছরে ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ৪৬০ টন। নতুন ভবনে ধারণ ক্ষমতা ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৪১ টন।

অন্য টার্মিনালের সঙ্গে সংযোগ: বর্তমানের দুটি টার্মিনালের সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনও সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে করিডোর নির্মাণ করা হবে।

সড়কের সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের সংযোগ: ঢাকা- ময়মনসিংহ হাইওয়ের সঙ্গে মূল সড়ক ছাড়াও এলিভেটেড ড্রাইভওয়ের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেলের একটি স্টেশন মাটির নিচে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল স্টেশনের সংযোগের জন্য টানেল নির্মাণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button