যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ন্যাশনাল সার্ভিসের শতকোটি টাকা লুট

ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ২০১০ সালে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি চালু করে সরকার। এ কর্মসূচির আওতায় বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের তিন মাস প্রশিক্ষণের পর সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের জন্য অস্থায়ী চাকরি দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণকালে প্রতিদিন ১০০ টাকা ভাতা আর চাকরিতে যোগদানের পর প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। বেতন-ভাতার পুরোটাই দেয় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। এজন্য জনপ্রতি সরকারের বরাদ্দ ১ লাখ ৫১ হাজার ৩২৯ টাকা। সব মিলিয়ে ১৩ বছরে এই কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

বিপুল এই টাকায় বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের কর্মসংস্থানের কথা থাকলেও নানা কায়দায় এর উল্লেখযোগ্য অংশ মেরে দিয়েছেন বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ তদন্তে মাত্র তিনটি উপজেলায় ৪১ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। কর্মসূচির আওতাধীন সব উপজেলায় কার্যক্রমের তদন্ত করা হলে কয়েকশ কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ন্যাশনাল সার্ভিসের মোট আটটি পর্ব শেষ হয়েছে। দেশের ১৯টি উপজেলায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির প্রথম পর্ব শুরু হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্বে উপজেলার সংখ্যা ছিল ৮টি। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৭টি উপজেলা নিয়ে শুরু হয় তৃতীয় পর্ব। কর্মসূচির চতুর্থ পর্ব শুরু হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। এতে উপজেলার সংখ্যা ছিল ২০টি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে একসঙ্গে তিনটি পর্ব চালু করা হয়। এর মধ্যে পঞ্চম পর্বে ২৪টি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম পর্বে ২০টি করে উপজেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে চালু হওয়া অষ্টম পর্বে উপজেলার সংখ্যা ছিল ১০টি। সব মিলিয়ে ৪৮টি জেলার ১৩৮টি উপজেলায় কর্মসূচিটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে মোট ২ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৭ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার ৯৯৬ জনের।

তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, বিপুল এই ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ মেরে দিয়েছেন কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামে বরাদ্দ, ভুয়া প্রশিক্ষণ, বাস্তবতার চেয়ে বেশি জনবল দেখানোসহ নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে টাকা তুলে নিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এমনকি কর্মসূচির বাইরে থাকা উপজেলার নামে অর্থছাড় করেও কোটি কোটি টাকা লুট হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের একটি চক্রের যোগসাজশে অভিনব এসব অনিয়ম ঘটেছে। অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ তদন্তে এরই মধ্যে এ ধরনের অন্তত তিনটি ঘটনার প্রমাণ মিলেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ন্যাশনাল সার্ভিসের অর্থ আত্মসাতের ঘটনার তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনও।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির ষষ্ঠ পর্বে রংপুরের মিঠাপুকুর এবং অষ্টম পর্বে যশোরের বাঘারপাড়া, ফরিদপুরের সালথা, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, পাবনার বেড়া, কক্সবাজারের মহেশখালী, পটুয়াখালী সদর, মাদারীপুরের শিবচর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা এই কার্যক্রমের আওতাভুক্ত ছিল। ওই অর্থবছরে কর্মসূচিতে মূল বরাদ্দ ছিল ৯৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ১১টি উপজেলার জন্য কল্যাণ অনুদান খাতে আরও ৪২ কোটি ৯৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।

সংশ্লিষ্ট নথি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ন্যাশনাল সার্ভিসের অডিটে ১১টি উপজেলা থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী কল্যাণ অনুদান খাতে মোট ব্যয় ছিল ৩৮ কোটি ৫৬ লাখ ২৭ হাজার ৬০০ টাকা। ফলে বরাদ্দ হওয়া অর্থের মধ্যে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা অব্যয়িত থাকার কথা। কিন্তু সরকারের সমন্বিত বাজেট ও হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থার (আইবাস++) কপিতে এ খাতে ব্যয় দেখা যায় ৪১ কোটি ১৪ হাজার ৬০০ টাকা। এতে কল্যাণ অনুদানের ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় চিহ্নিত হয়।

নিরীক্ষায় দেখা যায়, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির আওতায় না থাকলেও সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার জন্য ২০২২ সালের জুন মাসে আইবাস++ এ এন্ট্রি দিয়ে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন ও ব্যয় করা হয়েছে।

এই অনিয়ম নজরে আসার পর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক (দারিদ্র্য বিমোচন ও ঋণ) এ কে এম মফিজুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ওই তদন্ত কমিটি কাজ শেষ করতে পারেনি। অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীদের চাপে তদন্ত কার্যক্রম থেমে গিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা খতিয়ে দেখতে ২০২২ সালের ২ অক্টোবরে উপসচিব মো. ফজলে এলাহীকে আহ্বায়ক করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটির তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ। জানা যায়, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির আওতায় না থাকলেও সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার নামে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন ও ব্যয় করা হয়েছে। এভাবে মোট ১৩ কোটি ৯৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

তদন্ত শেষে ওই কমিটি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনে জকিগঞ্জ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আজহারুল কবির, গুলশান ইউনিটের যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অর্থ ও অডিটের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক, প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক ফরহাত নুর, সহকারী পরিচালক (অর্থ) ফজলুল হক, হিসাবরক্ষক নুরুল আমিন, অফিস সহকারী বাবুল পাটোয়ারী এবং জসিম উদ্দিন অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. ফজলে এলাহী কালবেলাকে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ করে আমরা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমার পক্ষে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।’

জানা গেছে, এ বিষয়ে এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠি দেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এতে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা দায়ের, ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আত্মসাৎ করা টাকা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এদিকে জকিগঞ্জের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গত জুনে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সিলেট কার্যালয়ে দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছেন প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রনজিত কুমার কর্মকার। তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম চলমান আছে। এরই মধ্যে ওই কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করছি।’

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জকিগঞ্জের ঘটনা নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যেই ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের একের পর এক ঘটনা বেরিয়ে আসছে। এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ তদন্তে রংপুরের গঙ্গাচড়া এবং সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাটের প্রমাণ মিলেছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ন্যাশনাল সার্ভিসের চতুর্থ পর্বে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলাকে যুক্ত করা হয়। দুই বছর মেয়াদে ওই উপজেলায় উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৭ জন। জনপ্রতি প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা করে ২৪ মাসে মোট ভাতার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এ খাতে ব্যয় হওয়ার কথা ৪৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু ওই উপজেলায় ভাতা বাবদ উত্তোলন করা হয়েছে ৬৬ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার ৬০০ টাকা। এ প্রক্রিয়ায় ২২ কোটি ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৮০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, লিখিত কাগজপত্র এবং আইবাসের মাধ্যমে অতিরিক্ত এই অর্থ বরাদ্দে মূল ভূমিকা রেখেছেন সেই সময় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের অর্থ ও অডিটের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বর্তমানে গুলশান ইউনিট থানার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। গঙ্গাচড়ার সাবেক উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এনামুল হকের মাধ্যমে ২২ কোটি টাকা উত্তোলনের পর বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করেন তারা।

একই প্রক্রিয়ায় সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা থেকে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মসূচির চতুর্থ পর্যায়ে ওই উপজেলায় মোট ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ২১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। কর্মসূচির আওতাধীন অন্যান্য উপজেলায় তদন্ত করা হলে এ ধরনের আরও ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা।

ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য চাওয়া হলে গুলশান থানা ইউনিটের যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ কালবেলাকে বলেন, ‘এগুলো মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে। প্রকৃত তথ্য সেখান থেকেই বের হবে।’

জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় অর্থ আত্মসাৎ প্রমাণিত হওয়ার পর দুর্নীতিবাজ চক্রটি নড়েচড়ে বসেছে। এরই মধ্যে তারা দুটি চালানের মাধ্যমে গঙ্গাচড়া উপজেলা থেকে আত্মসাৎ করা মোট ১৩ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন। তবে এখনো ওই উপজেলার ৯ কোটিরও বেশি টাকার হদিস নেই।

এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, এটি তার এখতিয়ারভুক্ত নয়। তিনি বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের যুব অনুবিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

পরে যুব-২ অধিশাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মোহা. লিয়াকত আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে যোগাযোগ করতে বলেন।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আজহারুল ইসলামকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে কিছু দিন আগে জকিগঞ্জের অনিয়মের ঘটনা নিয়ে তিনি কালবেলাকে বলেছিলেন, ‘ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাদের কয়েকজনকে এরই মধ্যে বদলি করা হয়েছে। বিভাগীয় মামলাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button