বিদায়ী বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরামর্শ সিইসির
দায়িত্ব নেওয়ার আড়াই বছরের মাথায় চার নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংবাদ সম্মেলন করে দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য রেখেছেন তিনি। তাতে তুলে ধরেছেন দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, অতীতের বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অভিমত।
পাশাপাশি ভবিষ্যতের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কিছু পরামর্শও দিয়ে গেছেন তিনি। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনসহ একাধিক ধাপে জাতীয় নির্বাচনের পরামর্শ উঠে এসেছে এর মধ্যে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষেও মত দিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় নির্বাচন নির্বাচন কমিশনে সংবাদ সম্মেলন করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যেই নিজের ও তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের অন্য নির্বাচন কমিশনারদের পদত্যাগের তথ্য জানান তিনি।
‘বর্তমান ও অতীত থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা সরকারের সদয় বিবেচনার জন্য কর্তব্য’ মনে করেছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, জনগোষ্ঠীর সমরূপতার (হোমোজেনিটি) কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয় ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে আয়োজন করা যেতে পারে।
সিইসি বলেন, প্রতিটি পর্বের মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে। প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করা হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।
নির্বাচন পদ্ধতির মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন উল্লেখ করে সিইসি বলেন, নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অত্যন্ত কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ বা দায়দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সবসময় কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায়, আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশীশক্তি বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।
নিজেদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর তথ্যও তুলে ধরেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। বলেন, কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দুই বছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি ও সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা অবাধ হওয়া নিয়ে আগের মতো ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি।
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বালি করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সে কারণে নির্বাচন হয়নি— এমন উদাহরণ নেই।
নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সরকার বারবার বলছেন যে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এ কথার মধ্যেই নিহিত।