হাঙ্গার প্রজেক্ট এর উদ্যোগে ঢাকায় সামাজিক সম্প্রীতি সংলাপ অনুষ্ঠিত
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট আত্মনির্ভরশীল, সমৃদ্ধ, মর্যাদাবান বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বিগত তিন দশক ধরে সারা দেশে নানাবিধ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশে সম্প্রীতির সুদীর্ঘ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রিডম অফ রিলিজিওন অর বিলিফ লিডারশীপ নেটওয়ার্ক(ফোর্ব)-এর সাথে যৌথভাবে একটি কার্যক্রম শুরু করেছে।
এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সংগঠন দুইটির উদ্যোগে আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার এক সামাজিক সম্প্রীতি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকার তোপখানা রোডে অবস্থিত সিরডাপ মিলনায়তনে সকাল ১০:৩০টায় অনুষ্ঠানটি শুরু হয়।
দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সামাজিক সম্প্রীতি সংলাপটির প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় সংসদ জনাব উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম। অতিথি হিসেবে অন্যান্যের মধ্যে ফোর্ব-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. শাহনাজ করীম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন) জনাব মুহাম্মদ রফিক-উল ইসলাম, বাংলাদেশ খ্রীষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জনাব নির্মল রোজারিও, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশের পরিচালক (কর্মসূচি) নাছিমা আক্তার জলি অংশগ্রহণ করেন।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৭১ সালে আমরাও রণাঙ্গণে ছিলাম। পাকিস্তান আমলে সম্প্রীতি রক্ষা করতে এরকম আলোচনার অনুষ্ঠান করতে হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে এখন করতে হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে শাসক ছিল স্বৈরাচারী, রাষ্ট্র ছিল সাম্প্রদায়িক। কিন্তু মানুষ ছিল অসাম্প্রদায়িক। ধর্ম ছিল যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। আমরা পরিচিত হতাম বাঙ্গালি হিসেবে। কিন্তু স্বাধীন দেশে এর বিপরীত হচ্ছে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম যোগ করলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদলে দেশ চালাতে লাগলেন। এরশাদ সাহেব এসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করলেন এবং এর মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করলেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের। এ সরকারের ১৩ বছরেও তাই হয়েছে, যা বিগত দিনগুলোতে হয়ে আসছে। আর এ জন্য দায়ি রাজনীতিবিদরা। বস্তুত নাগরিকদের নাগরিক না ভেবে ধর্ম দিয়ে বিবেচনা করলে সাম্প্রদায়িকতা গেঁড়ে বসবেই।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, উন্নয়নের অপর নাম হলো সম্প্রীতি। সম্প্রীতি যদি না থাকে তাহলে উন্নয়ন হয় না। উন্নয়ন হলেও ঠেকসই হবে না। মূলত তিনভাবে সামাজিক সম্প্রতীতি বিনষ্ট হয়: বিভাজনের রাজনীতি, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং জাতিগত বিভেদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একে অপরকে রক্ষা করলেও এখন নিশ্চিহ্ন করতে ওঠে পরে লেগেছি। বস্তুত রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদের কারণে আমরা এক বারুদের স্তুপের ওপর দাড়িঁয়ে আছি। তাই আমাদের সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানো। এর বিকল্প নেই। এ থেকে পরিত্রাণ না পেলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ধর্মকে বাদ দিয়ে আমরা কিছু করতে পারি না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা পূজা মণ্ডপে আঘাত আসতে দেখেছি। ৩০টিরও বেশি জেলায় এটি হয়েছে। দুঃখজনক হলো সাধারণ মানুষের মধ্যে কেও এগিয়ে আসলো না মণ্ডপ রক্ষার্থে। বর্তমানে দেশের সব জায়গায় আওয়ামী লীগের পক্ষের লোক পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখিনি আওয়ামী লীগের কোনো মেম্বার, কাউন্সিলর বা নেতা এক দুইশো অনুসারী নিয়ে মণ্ডপ রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ সবগুলো ছাত্র সংগঠন তাদের কার্যক্রম চালাতে পারতো। তাদের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি যেমন হতো, আবার সংকটকালে একও হয়ে যেতো। কিন্তু এখন একদল, ভিন্নমত নেই। এটিও একটি বড় সংকট।
উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম বলেন, আমাদের সবকিছু তৈরি হয়ে আসে ঘর থেকে। তাই সমাজিক সম্প্রীতি বির্নিমাণে আমাদের শুরু করতে হবে একদম ঘর থেকেই। বাবা-মা আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে এবং যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি আমাদের সবার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নাছিমা আক্তার জলি বলেন, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশে এসডিজি ইউনিয়ন গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এসডিজির ১৬ নম্বর গোলের লক্ষ্য হলো টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার প্রচলন, সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিতাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ করা। আমরা চাই সমাজে সামাজিক সম্প্রীতি বাজায় থাকুক। এ লক্ষ্যে আমাদের এক লাখেরও বেশি তরুণ স্বেচ্ছাব্রতী দেশব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সব মানুষের জন্য একটি বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও এ দেশ সব মানুষের হয়নি। এ দেশ সংখ্যলঘুদের হয়নি, গরীবদের হয়নি, নিঃস্বদের হয়নি। উল্টো আমরা দেখছি এ দেশ হয়েছে কতিপয় লুটেরাদের। শক্তিশালী হয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। আর এর সবচেয়ে বড় ভিক্টিম হচ্ছে নারী। একুশ শতকে এসে আফগানিস্তানে প্রশ্ন ওঠেছে, আফগান নারীরা শিক্ষা নিতে পারবে কি না। আমাদের দেশেও এই ফেব্র“য়ারি মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলার শিকার হয়েছিলেন। সমাজ বর্তমানে আরও বিভাজনের দিকে চলে গেছে।
শাহানাজ করীম বলেন, আমাদের এই প্রজেক্টটি ছোট হলেও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট এতে সম্পৃক্ত হওয়াতে এর ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি নাগরিক সংগঠন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিককেও আমরা পাশে পাচ্ছি। এছাড়াও স্থানীয় নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে প্রজেক্টটি পরিচালিত হচ্ছে।